Language Conflict

ভাষার দেওয়াল তুলে

একুশ শতকের শুরুতে মনে করা হয়েছিল, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও মূল্যবোধের দিগন্ত এতটাই খুলে গিয়েছে যে, ভাষা, ধর্ম ও জাতীয়তার যে পরিচয়গুলি বিশ শতকে নাগরিকের অস্তিত্ব আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল, তা সহজ হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:১৭

ভাষা কী? ছোটবেলার বইয়ে পড়া প্রথম ‘সংজ্ঞা’: ভাষা ভাবপ্রকাশের মাধ্যম। মানুষ নিরন্তর ভেবে যাচ্ছে— সব ভাব ও ভাবনা যে প্রকাশযোগ্য, তা-ও বলা যাবে না— তবু মানুষ মুখ ফুটে বলে ফেলে তা। কলকাতা মেট্রোয় দুই সহযাত্রিণীর কথা কাটাকাটির ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেখানে হিন্দিভাষী এক জন বাংলাভাষীকে জিজ্ঞাসা করছেন: কেন তিনি বাংলায় কথা বলছেন, এটা তো বাংলাদেশ নয়, এটা ভারত, আর “ইন্ডিয়া কা ল্যাঙ্গুয়েজ হ্যায় হিন্দি।” ভারতে থাকো, হিন্দি জানো না? উল্টো দিকে শোনা গিয়েছে বাঙালি মেয়েটির গলা, “আমি বাঙালি, আমি ভারতীয়, এটা আমার মাটির ভাষা।” পরিস্থিতি পরে পৌঁছেছে কর্তৃপক্ষের দুয়ারে এবং শেষাবধি এক রকম নিষ্পত্তিতে; অন্য দিকে গণমাধ্যমে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্ব: বঙ্গভূমে ‘হিন্দি বনাম বাংলা’ লড়াইয়ে কে জয়ী আর কে ধরাশায়ী— তার শব-ব্যবচ্ছেদ।

Advertisement

একুশ শতকের শুরুতে মনে করা হয়েছিল, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও মূল্যবোধের দিগন্ত এতটাই খুলে গিয়েছে যে, ভাষা, ধর্ম ও জাতীয়তার যে পরিচয়গুলি বিশ শতকে নাগরিকের অস্তিত্ব আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল, তা সহজ হবে। তা যে হয়নি, এই সময়ের নানা বিভাজনই তার প্রমাণ। ‘বনামতন্ত্র’ই এখন শেষ কথা: কেন্দ্র বনাম রাজ্য, হিন্দু বনাম মুসলমান, হিন্দি বনাম বাংলা ইত্যাদি মাঝে রেখে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাচ্ছে নাগরিক সমাজ। এমন নয় যে, ভারতের নাগরিকেরা এই বিশাল দেশের ভাষা-মানচিত্রের বৈচিত্র ও গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত নন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি যে অতীতেও বাংলা ভাষাতেই কথা বলে এসেছেন, এখনও বলছেন এবং ভবিষ্যতেও তা-ই বলবেন, এ কথা বুঝতে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানের বেশি কিছু প্রয়োজন পড়ে না। যে কোনও ভাষাভূমের ক্ষেত্রে তা সত্য: গুজরাতে গুজরাতি, ওড়িশাতে ওড়িয়া, দক্ষিণে তামিল তেলুগু কন্নড় মালয়ালমই বলা হবে প্রথমত ও শেষ পর্যন্ত। এই ভাষাবৈচিত্রই ভারতের সম্পদ, এ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনারও ভিত্তি সেখানেই। সংবিধান খুললেও তা-ই দেখা যাবে, স্বীকৃত সব ভাষারই মর্যাদা সমান, ভারতের কোনও একক ‘রাষ্ট্রভাষা’ নেই। কোনও ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল এর বিপ্রতীপে একটিমাত্র ভাষাকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চাইলে বুঝতে হবে তারা হয় বিভ্রান্ত, কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিপথে চালিত।

ভারতে থাকলে হিন্দি জানতে ও বলতে হবে, এমনকি খাস পশ্চিমবঙ্গেও: সাধারণ নাগরিকের এই জবরদস্তি দাবির উৎসটি এই সময়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি-প্রভাবিত, এ কথা এখন আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বিজেপির ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির অন্য অভিমুখগুলিই হল এক ভাষা এক ধর্ম ইত্যাদি, ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান’ স্লোগানের অন্তর্গত ধারণাটি তারা সফল ভাবে রাজনীতি তথা ভোটের ময়দান থেকে সমাজ ও জনজীবনেও চারিয়ে দিতে পেরেছে। এরই আর একটি দিক হল বাংলাকে শুধুই বাংলাদেশের ভাষা, বাংলাভাষী মাত্রকেই বাংলাদেশি তথা বহিরাগত পরিচয়ের সমার্থক বলে চালানো। সাম্প্রতিক ঘটনাটি খাস কলকাতার বলে এত শোরগোল পড়েছে, নয়তো একটু তলিয়ে দেখলেই বেরিয়ে পড়ত দেশের নানা প্রান্তে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমজীবীদের নিপীড়িত হওয়ার নানা ঘটনাও— দুই-ই আসলে একই আধুলির দুই পিঠ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছেন বাংলা ভাষায় কথা বলা ভারতীয়রা। সমাজমাধ্যমে চাপানউতোরে উঠে এসেছে বাঙালিদের আক্ষেপ ও উষ্মা: কলকাতা চোখের সামনে অন্য ভাষাভাষী মানুষের স্বর্গোদ্যান হয়ে উঠছে, ব্যাঙ্ক হোটেল শপিং মল এমনকি মোবাইলের ও-পারে পরিষেবা-প্রদানকারী মানুষগুলিও প্রধানত হিন্দি ভাষায় কথা চালিয়ে যেতে উৎসাহী। এর উল্টো পিঠেই আছে এই আত্মকরুণা: একুশ শতকের বাঙালি আপন মাতৃভাষা ও ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি চরম অবহেলা দেখাচ্ছে অনেক দিন যাবৎ, সেই কৃতকর্মের ফল তো ভুগতে হবেই। এই কার্য-কারণ বিশ্লেষণ হয়তো সমাজতাত্ত্বিকদের ব্যাপার, কিন্তু ঘরে-বাইরে এই যে ভাষিক বা ভাষাকেন্দ্রিক হিংসা, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছুই হতে পারে না। ভাষার কোনও ছোট-বড়, উঁচু-নিচু হয় না: বাংলা ভাষায় পথের পাঁচালী লেখা হয়েছে বলেই তা সংস্কৃত বা স্প্যানিশ ভাষার চেয়ে বড়, এ-হেন কথার কোনও অর্থ নেই। ভাষা নিয়ে রাজনীতি আজকের নাগরিককে করে তুলছে বিভেদ ও বিদ্বেষের কারবারি, তা থেকেই আসছে কোনও একটি ভাষার প্রতি পক্ষপাত, অন্য ভাষার প্রতি তাচ্ছিল্য। এই ভাষিক হিংসা পরিহার করতেই হবে, নান্যঃ পন্থাঃ।

আরও পড়ুন
Advertisement