Narendra Modi

নিরন্তর সতর্কতা

ভারতীয় গণতন্ত্রের এক ঐতিহাসিক অর্জন। একতন্ত্রের পক্ষে যা দুঃখের, গণতন্ত্রের পক্ষে তা কেবল আনন্দের নয়, বড় ভরসার কারণ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২৪ ০৯:০৫
লাল কেল্লায় নরেন্দ্র মোদী। ১৫ অগস্ট ২০২৪।

লাল কেল্লায় নরেন্দ্র মোদী। ১৫ অগস্ট ২০২৪। ছবি পিটিআই।

নরেন্দ্র মোদী লালকেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর এগারো নম্বর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে অনেক কথা বলেছেন। কথাগুলি প্রত্যাশিত ভাবেই হিসাব করে বলা। রাজনীতির হিসাব। যেমন, নারীর লাঞ্ছনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রকারান্তরে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের উদ্দেশে তোপ দেগেছেন তিনি, আবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করলেই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসার ঘটবে বলে নাগপুরের কর্মসূচিতে নতুন ইন্ধন সরবরাহ করেছেন, হিন্দুত্ববাদীদের প্রাণে নতুন উদ্দীপনা। বর্তমান ভারতে এ-সবই অবধারিত। কিন্তু অনুমান করা কঠিন নয় যে, তিনি সযত্নে গোপন রেখেছেন এ-বারের ভাষণ প্রদানের সময় আপন মনের অনুভূতি, গত দশ বারের থেকে যা স্বতন্ত্র। গোপন রাখার কারণ, সেই নতুন অনুভূতিটি তাঁর পক্ষে আনন্দের নয়। তাঁর মতো রাজনীতিকরা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং অবিসংবাদিত আধিপত্যের অনুরাগী। দশ বছর সেই একাধিপত্য ভোগ করার পরে লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাতছাড়া হয়েছে, শরিক-নির্ভর সরকার চালাতে বাধ্য হয়েছেন দলের সর্বাধিনায়ক। মনে মনে তিনি বিষণ্ণ বোধ করতেই পারেন। আর সেই কারণেই ২০২৪ সালের ১৫ অগস্ট নিছক ক্যালেন্ডার-ঘটিত পুনরাবৃত্তি নয়। তিন মাস আগে ভোটের ফল ঘোষণার সময় দেশে যে স্বস্তির সুপবন সঞ্চারিত হয়েছিল, আজ তা কালের নিয়মে অতীত হয়েছে বটে, কিন্তু অসহিষ্ণু শাসকের বজ্রমুষ্টি যে সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিগুণ দাপট সংগ্রহ করে নেওয়ার সুযোগ পায়নি, চারশো পার করার আস্ফালনকে যে জনাদেশের কাছে পরাজয় মানতে হয়েছে, সেটা ভারতীয় গণতন্ত্রের এক ঐতিহাসিক অর্জন। একতন্ত্রের পক্ষে যা দুঃখের, গণতন্ত্রের পক্ষে তা কেবল আনন্দের নয়, বড় ভরসার কারণ।

Advertisement

ভরসা কেবল মূল্যবান নয়, পরম সমাদরণীয়। কিন্তু তাকে সার্থক করে তোলার কাজটি সহজ নয়। সেই কাজে ব্রতী না হলে টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের লেজ থেকে উধাও হয়ে যেতে ওই ভরসার বিন্দুমাত্র দেরি হবে না। ইতিমধ্যেই, নির্বাচনের তিন মাস পরেই, ভারতীয় রাজনীতির হালচাল দেখে ভূয়োদর্শী নাগরিকের এই বিষয়ে চিন্তিত বোধ করার কারণ আছে। একাধিক কারণ। প্রথমত, শাসক শিবিরের মানসিকতায় ও আচরণে যথার্থ আত্মসংশোধনের কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন-উত্তর প্রারম্ভিক ভাষণে ‘এনডিএ’-র নাম কীর্তনের বাড়াবাড়ি শুনেই অনুমান করা গিয়েছিল, জোটধর্ম ওই উচ্চারণেই সীমিত থাকবে, আচরণে তার ঠাঁই হবে না। গুরুত্বপূর্ণ দুই শরিক দলকে প্রধানত আর্থিক সুবিধার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করার চতুর কৌশল প্রয়োগ করে সেই অনুমানকে নির্ভুল প্রমাণ করেছেন শাসকরা, অতঃপর সংসদের প্রথম অধিবেশনে স্পিকার নির্ধারণের পর্ব থেকেই তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’তে দাপট অপরিবর্তিত রাখার ব্যাপারে তাঁদের খেলার প্রতিভা বিপুল। দ্বিতীয়ত, গত দশ বছরে তাঁরা সংবিধান ও আইন তথা সংহিতার সংশোধন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কব্জায় আনার প্রক্রিয়াটি এত দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওজন কয়েক ছটাক কম হলেও সম্ভবত আধিপত্য জারি রাখতে সমস্যা নেই। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তন করেই ছাড়ব— স্বাধীনতা দিবসের এই প্রচ্ছন্ন আস্ফালনও সেই বার্তাই দিল।

এই মজ্জাগত আধিপত্যবাদকে প্রতিহত করে ভারতীয় গণতন্ত্রের নবলব্ধ ভরসাকে যদি চরিতার্থ করতে হয়, তবে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে প্রতিস্পর্ধী সতর্কতা এবং সক্রিয়তার কোনও বিকল্প থাকতে পারে না। এ বিষয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দায়িত্ব স্বভাবতই বিপুল। সংসদে এবং তার সামনে বাঁধা গতের বিক্ষোভ কর্মসূচি প্রদর্শন করে সেই দায়িত্ব পালন করা চলে না, তাদের আচরণে এই বোধের যথেষ্ট প্রতিফলন ঘটছে না, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর জন্য নরেন্দ্র মোদীকে দুয়ো দিয়েই যেন তারা পরম আহ্লাদিত। উদ্বেগের কারণ বইকি। আরও বড় উদ্বেগ তাদের নিজেদের গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়েই। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের ভয়াবহ ঘটনাবলি প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দেখিয়ে দেয়, দলীয় আধিপত্যের অনাচার নাগরিকের অধিকারকে কী ভাবে দলিত এবং লাঞ্ছিত করে চলতে পারে। সুতরাং গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসাবে অতন্দ্র সামাজিক চেতনা ও আপসহীন সামাজিক আন্দোলনের ভূমিকা অপরিহার্য। লালকেল্লার বক্তৃতা ও অন্যান্য গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতাকে অতিক্রম করে এখন বিশেষ ভাবে স্মরণ করা দরকার সেই পুরনো ও বহুপরিচিত বাক্যটি: নিরন্তর সতর্কতাই স্বাধীনতার সত্যমূল্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement