বাংলাদেশে সাধু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস প্রভুকে নিয়ে যে কাণ্ড চলছে, তার ফলে একটি ভয়ানক বাস্তব রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার উপরিতলে উঠে এল, এমনকি কূটনীতির মঞ্চে তরঙ্গ তোলার স্তরে পৌঁছল। ইসকন-কে ‘মৌলবাদী সংগঠন’ হিসাবে চিহ্নিত করে সেখানকার সরকারি অ্যাটর্নি জেনারেল-এর মন্তব্য পৃথিবীর সামনে স্পষ্ট করে দিল বর্তমান বাংলাদেশ সরকারে যাঁরা উপবিষ্ট, তাঁদের গভীর সংখ্যালঘু-বিদ্বেষের বাস্তবটিকে। ভারত সরকার স্বভাবতই অতি বিচলিত। দ্ব্যর্থহীন দৃঢ় বার্তা দিয়েছে দিল্লি, যে কোনও ভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করুক বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। দেশের সংখ্যালঘুকে নিরাপত্তা দিতে দেশের শীর্ষনেতা মুহাম্মদ ইউনূস প্রবল ভাবে ব্যর্থ— এই বার্তা দিয়ে ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম-এর প্রধান জনি মুর আন্তর্জাতিক উদ্বেগকেও সামনে এনে একটি জরুরি ভূমিকা পালন করলেন। এত দিন যা চলছিল আড়াল আবডাল দিয়ে, এ বার তা খোলা আলোয় বেরিয়ে এল— বহু দুঃসংবাদের মধ্যেও এটুকু এক শুভ ইঙ্গিত। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকে বাংলাদেশে যে সংখ্যালঘু পীড়ন, নির্যাতন হয়ে চলেছে, কোথাও তার প্রতিকারের জন্য রব ওঠা দরকার। আশা করা যায়, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হবে, ঢাকার রাজনীতি-চালকরা নড়েচড়ে বসবেন, মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সরকারের পিছনে যে রাজনৈতিক মদতদাতা গোষ্ঠী, তাঁদের সতর্ক করা যাবে। যে ভাবেই হোক, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, বিশেষত বাংলাদেশি হিন্দু ও বৌদ্ধ নাগরিকদের উপর এই বিপুল নির্যাতন এখনই কড়া হাতে বন্ধ করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। মুহাম্মদ ইউনূস শান্তির প্রচারক হিসাবে বিশ্বস্বীকৃতি-প্রাপ্ত, নোবেল শান্তি পুরস্কার-ভূষিত, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই ইতিহাস রচিত হচ্ছে— এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে।
ভারতের পক্ষে বাস্তবিক এ এক ভয়াবহ উদ্বেগের সময়। সেই জুলাই মাস থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন ও শেখ হাসিনা-বিরোধী অভ্যুত্থান ভারতবিরোধিতার চড়া সুরে বাঁধা। পালাবদলের অব্যবহিত পর সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন প্রবল আকার ধারণ করল সে দেশে, মফস্সল শহরে গ্রামে, এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও। ন্যক্কারজনক রবীন্দ্রবিরোধিতার মোড়কে হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার চলেছে, নানা স্থানে হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙা হয়েছে। চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের উপর নেমে এসেছে অমানুষিক অত্যাচার। আওয়ামী লীগের সমর্থক কিংবা ভারতের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী, এই সব কারণ দেখিয়ে যৎপরোনাস্তি নাকাল করা হচ্ছে সাধারণ সংখ্যালঘুকে। তবে সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে স্তম্ভিত করে নতুন অন্তর্বর্তী-কালীন সরকারের মনোভাব। আদৌ যে তাঁরা এই বিদ্বেষের প্রচ্ছন্ন সমর্থক নন, তাঁদের আচরণ সেটুকুও প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। বাস্তবিক, আন্দোলন চলাকালীনই বিরোধী নেতৃত্বের সংখ্যালঘু বিদ্বেষ নানা ভাবে সামনে চলে এসেছিল। কিন্তু তখন অনেকেই তা স্বীকার করতে চাননি, কিংবা আন্দোলনের অতিরেক হিসাবে তাকে উপেক্ষা করেছিলেন।
আরও একটি বিপদের কথা। এই উপমহাদেশের কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীকে বিশেষ ভাবে বিপন্ন করে, যার হেতুটি নিহিত ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের আশ্চর্য ইতিহাসের মধ্যে। এবং তৎপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মধ্যে। সহজ হিসাবেই, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন যেমন ভারতকে তীব্র সঙ্কটে ফেলছে, তেমনই পাকিস্তানকে বিশেষ উজ্জীবিত করছে। যে-হেতু বিজেপি শাসনাধীন ভারতে মুসলমান-বিদ্বেষ এই মুহূর্তে যথেষ্ট প্রকট, এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে যাতে নতুন করে কোনও সঙ্কট তৈরি না হয়, অনিয়ন্ত্রিত গুজব রটনা কিংবা বিদ্বেষে ইন্ধন জোগানো না হয়, এ সব নিশ্চিত করার ভার রইল যুগপৎ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উপর।