উৎসবের দূষণ বিষয়ে প্রতি বছর আশঙ্কা যেমনটি থাকে, তাকে সত্যি হতে দেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে এ রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের। যেমন, কালীপুজোর ঢের আগে থেকেই শব্দবাজির তাণ্ডব দেখে আশঙ্কা করা হয়েছিল, এই বারের দীপাবলি ও তার পরের দিনটিতে শব্দতাণ্ডব মাত্রা ছাড়াবে। তা ইতিমধ্যেই সত্য প্রমাণিত। বহু ক্ষেত্রে থানায় ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলত, দীপাবলি এবং তার পরের দিনের বাতাস ধোঁয়া আর বারুদ-গন্ধে মাতোয়ারা থেকেছে। বিসর্জনেও একই চিত্র। পুলিশের ঘোষণা সত্ত্বেও রবিবার বিভিন্ন ঘাটে যত্রতত্র শব্দবাজি ফেটেছে। কলকাতা পুলিশ অবশ্য এ বছর অভিযোগ কম জমা পড়ার এবং শব্দবাজি আটক করার তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিয়মভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সংখ্যাও নাকি আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু তার পরেও যে পরিমাণ শব্দবাজি এমনকি হাসপাতাল চত্বরেও নির্বিচারে ফেটেছে, তা দেখে বাজারে বেআইনি বাজি মজুতের বিপুল পরিমাণটি সহজে আন্দাজ করা যায়। পুলিশ-প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এই পরিমাণ বেআইনি বাজি মজুত হল কী ভাবে, সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি।
বাজি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-প্রশাসনের এই ব্যর্থতা শুধুমাত্র শব্দদূষণই নয়, বায়ুদূষণের মাত্রাকেও উদ্বেগজনক হারে বাড়িয়ে তোলে। অবশ্য দীপাবলির মরসুমে এই বছর সামগ্রিক ভাবে সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকায় (আইজিপি) দূষণচিত্রের সাপেক্ষে কলকাতার অবস্থানটি কিছুটা স্বস্তিদায়ক। ভারতে পঞ্জাব থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত এই নদী অববাহিকা কুখ্যাত তার দূষণ প্রাবল্যের কারণে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানগুলি দেখিয়েছে, দীপাবলির ঠিক আগে-পরের সময়কালে এই নদী অববাহিকা-স্থিত সবচেয়ে কম দূষিত শহরগুলির মধ্যে কলকাতা ছিল অন্যতম। দেওয়ালি-পরবর্তী দূষণের নিরিখে কলকাতাকে অনেক পিছনে ফেলেছে গাজ়িয়াবাদ, বিকানের এবং দিল্লি। কালীপুজোর ঠিক পরের দিনগুলিতে কলকাতার দূষণমাত্রা বৃদ্ধি পেলেও তা অন্য শহরগুলির তুলনায় যথেষ্ট কম। কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই। কারণ, কলকাতায় এই বছর দূষণ মাত্রা না ছাড়ানোর অন্যতম কারণ প্রশাসনিক কৃতিত্ব নয়, শহরের তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়া। ঠান্ডা আবহাওয়ায় পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে এ শহরেও আরও জটিল হত।
বরং মনে রাখা প্রয়োজন, ৩১ অক্টোবর যেখানে শহরের বাতাসের গুণমান ‘সন্তোষজনক’ ছিল, সেখানে পরের দু’দিনে তা দ্রুত ‘মাঝারি’, ‘খারাপ’, এমনকি একটি অঞ্চলে ‘অতি খারাপ’-এর পর্যায়েও নেমে আসে বাজির কল্যাণে। বিশেষত বালিগঞ্জের মতো জনবহুল অঞ্চলে বাতাসের গুণমান ‘খারাপ’-এর পর্যায়ে নেমে আসা এবং কিছু দিন স্থায়ী হওয়া উদ্বেগের বিষয়। বাজিতে নিয়ন্ত্রণ জরুরি এই কারণেই। বিশেষজ্ঞরা বহু বার জানিয়েছেন, বাতাসের গুণমানের উপর জনস্বাস্থ্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। সেই মানে অবনমনের অর্থ বিপুল সংখ্যক মানুষকে জটিল অসুখের দিকে ঠেলে দেওয়া। প্রশাসন এ ক্ষেত্রে নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। শব্দবাজির ক্ষেত্রে অবশ্য কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে অভিযোগের নিরিখে এলাকাভিত্তিক ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা কবে হবে, ছটপুজো এবং বছর শুরুতে তার সুফল আদৌ পাওয়া যাবে কি না, সবই এখনও অথৈ জলে।