ফাইল চিত্র।
সুখ ও দুঃখ চক্রাকারে পরিবর্তিত হয়, শাস্ত্রবাক্য। অদৃষ্টের পরিহাস, ধর্মস্থান তথা তীর্থস্থান দর্শনসুখও এই ভারতে নিয়ম করিয়া দুর্ঘটনার দুঃখে পাল্টাইয়া যায়। বৎসর-শুরুর ভোর রাতে জম্মুর বৈষ্ণো দেবী মন্দিরে ভিড়ে পদপিষ্ট হইয়া বারো জন মারা গেলেন, সকলেই ছিলেন দর্শনার্থী। দর্শনার্থীরাই প্রয়োজনাতিরিক্ত ভিড় জমাইয়াছিলেন, ভিড়ের মধ্যে কী কারণে কিছু মানুষের মধ্যে বচসা শুরু হয়, তাহার জেরেই ঠেলাঠেলি এবং এই মর্মান্তিক পরিণতি। দেববিগ্রহ দর্শনের পুণ্য সঞ্চয়ে বর্ষশুরুর ভাবনা আসিয়া ঠেকিল অনভিপ্রেত মৃত্যুতে।
দুর্ঘটনার পরবর্তী প্রশাসনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুমান কঠিন নহে। বৈষ্ণো দেবী মন্দির বোর্ডের লোকজন, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী, আধিকারিকগণ খবর পাইতেই ছুটিয়া যান, তাঁহাদের হস্তক্ষেপ ভিন্ন বিপর্যয় আরও বড় হইতে পারিত। পরিস্থিতি আয়ত্তে আসিবার পরে দেবদর্শন ভালই চলিয়াছে, বাকি দিনে অন্তত ২৭ হাজার পুণ্যার্থী সুরক্ষিত ভাবে মন্দিরে বিগ্রহ দর্শন করিয়াছেন। অন্য দিকে মৃতদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শোকপ্রকাশ, ক্ষতিপূরণের ঘোষণা, সবই ঘটিয়াছে অনতিবিলম্বে। আর এ-হেন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যেমনটি হইয়া থাকে, সেই তদন্ত কমিটি গড়িয়া তদন্তের নির্দেশ, সাত দিনের মধ্যে রিপোর্টে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের পদক্ষেপটিও সম্পন্ন। সবই হইয়া গিয়াছে— চক্রবৎ, যন্ত্রবৎ নৈপুণ্যে। তাহা হইলে বাকি রহিল কী? সময়ের চাকা ঘুরিয়া পরবর্তী ঘটনা তথা দুর্ঘটনা ঘটিবার অপেক্ষা— যাহাতে পুনরায় এই সুদক্ষ সক্রিয়তা দেখানো যায়? দুর্ঘটনা ঘটিবার ‘পরে’ নহে, ‘পূর্বে’ কোন তৎপরতা দেখাইলে বরং মন্দিরদ্বারে পুণ্যার্থী-সমাগম সুশৃঙ্খল সুনিয়ন্ত্রিত থাকে, দুর্ঘটনা ঘটিবারই কোনও অবকাশ থাকে না, মন্দির বোর্ড হইতে প্রশাসন তাহা ভাবিবে না? এমন নহে যে এ-হেন দুর্ঘটনা এই প্রথম ঘটিল, এইরূপ হইতে পারে তাহা পূর্ব হইতে ভাবা যায় নাই এমনও নহে। বৈষ্ণো দেবীর মন্দির ভারতের আর পাঁচটি মন্দিরের ন্যায় নহে, পুণ্যার্থীদের কাছে তাহার স্থানমাহাত্ম্য ও ভাবমহিমা অন্য স্তরে উত্তীর্ণ, সেই জন্যই সেখানে এত ভক্তসমাগম, ভোরের আলো না ফুটিতেই ভিড়। সেই ভিড়কে শৃঙ্খলায় বাঁধিবার ব্যবস্থা পূর্ব হইতে থাকিবে না?
বারোটি প্রাণ চলিয়া যাইবার পর এখন শুনা যাইতেছে বহুবিধ আধুনিক পদক্ষেপের কথা: ভিড় সামলাইবার কার্যকর ব্যবস্থা, বৈষ্ণো দেবী যাত্রা বুকিং সম্পূর্ণ অনলাইন করা, দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাঁধিয়া দেওয়া, পুণ্যার্থীদের প্রবেশ ও প্রস্থানপথ পৃথক করা ইত্যাদি। ভাবিলে আশ্চর্য হইতে হয়, এই সকল পদক্ষেপ মন্দির বোর্ড ও প্রশাসন এত দিন ভাবে বা করে নাই? যে মন্দির দর্শনে তেরো কিলোমিটার ট্রেকিং করিয়া পুণ্যার্থীদের আসিতে হয়, তাহার কর্তৃপক্ষের এবং সেই সঙ্গে জম্মু প্রশাসনেরও প্রতি পদে মানুষের সুরক্ষা ও সুব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা সর্বৈব গুরুত্ব দিয়া ভাবা উচিত ছিল। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পরেও সত্বর সব সামলাইয়া দেওয়া গিয়াছে, এমনকি দর্শনও থামে নাই— ইহা কোনও কৃতিত্বের কথা নহে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দুর্ঘটনার কারণ ও সেই মতো দোষীদের চিহ্নিত করিবার কথা। কিন্তু মন্দির বোর্ড ও প্রশাসনের অব্যবস্থা ও প্রস্তুতিহীনতার উল্লেখ থাকিবে কি না, সংশয় থাকিতেছে। ভয়ও। বৈষ্ণো দেবীর মন্দিরে পুণ্যার্থীদের দুর্ঘটনা ও মৃত্যুকে নিয়তিনির্দিষ্ট বলিয়া দাগাইয়া দিবার ভয়।