তবে কি সরিষার মধ্যেই ভূতের বাস? উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানার জাতপাত, ধর্ম ও লিঙ্গভিত্তিক যে সমাজ-রাজনীতির সালিশি-পুলিশি ও রক্তচক্ষুর উদাহরণ তুলিয়া ধরিয়া পশ্চিমবঙ্গ এই সেই দিন পর্যন্ত বলিত তাহার ঘরে এই জিনিস নাই, উহা কি মিথ্যা? নদিয়ার কৃষ্ণনগরের সাম্প্রতিক ঘটনা সেই ইঙ্গিতই দিতেছে, নচেৎ ‘প্রাক্তন’ বিজেপি কর্মী ও বর্তমান ‘সমাজসেবী’ বলিয়া পরিচিত এক মহিলা প্রকাশ্য দিবালোকে, প্রেমসম্পর্কে আবদ্ধ দুই ধর্মের দুইটি ছেলেমেয়ের চুল কাটিয়া লইয়া, ছেলেটির মোবাইল ফোন কাড়িয়া লইয়া তাহাকে মারধর করিবেন কেন। পুলিশ মহিলাকে গ্রেফতার করিয়া মামলা রুজু করিয়াছে, তাহা পরের কথা। কিন্তু ভরা বাসস্ট্যান্ডে জনসম্মুখে, এমনকি প্রণয়ীযুগলের পরিবারের লোকের অনুরোধ উড়াইয়া যে এই দুরাচার সম্ভব হইল, তাহা বিস্ময়ের। এবং শঙ্কারও— সর্বদা অন্য রাজ্যের ‘খাপতন্ত্র’ আঙুল দিয়া দেখাইয়া, নিজে আত্মগর্বে ভাসিয়া যাওয়ার চির অভ্যস্ততায় বাধার শঙ্কা।
পশ্চিমবঙ্গে খাপতন্ত্রের প্রবণতা অলক্ষ্যে গোকুলে বাড়িয়া উঠিবার সঙ্কেত ইহা, মনে হইতে পারে। কিন্তু রাজনীতির তাত্ত্বিক হইতে মাথা খাটানো নাগরিক মাত্রেই অবগত, এই রাজ্যে জনপরিসর ও রাজনীতিতে আধিপত্যবাদী প্রবণতা নাই তাহা নহে, অন্য রূপে আছে। নাগরিকের ধর্ম বা জাতপাতের পরিচয় পশ্চিমবঙ্গে তত আমল পায় নাই, যত পাইয়াছে ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়। হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নহে, সিপিএম-তৃণমূল-বিজেপি— কে কোন রাজনৈতিক দলের অনুগামী, তাহাই এখানে বিবেচ্য। এবং ইহা আজিকার কথা নহে, বরাবরের কথা। দল ও দলীয় প্রভাব এই রাজ্যে কর্মী-সমর্থক তথা সাধারণ নাগরিকের সমাজজীবনের তো বটেই, অনেকাংশে ব্যক্তিজীবনেরও নিয়ন্ত্রক। দল বলিলে তাঁহাকে জমি ছাড়িয়া দিতে হইবে, শিক্ষা-চাকুরি-বিবাহের ক্ষেত্রেও দলের মতামত শুনিতে হইবে, ঘরের ছেলে বা মেয়েটি কাহার সঙ্গে মিশিবে, বা মিশিবে না, ‘পার্টি’ বা ‘লোকাল কমিটি’ ঠিক করিয়া দিতেই পারে। অর্থাৎ অন্য রাজ্যে গ্রামীণ মহাবৃক্ষতলে আসীন সমাজবৃদ্ধরা যে কাজ করেন, এই রাজ্যেও সেই সালিশি-পুলিশি সবই হইতেছে, করিতেছেন রাজনৈতিক নেতারা। ধর্ম-জাতপাতের পথে নহে, অন্য মোড়কে।
দল নানা রঙের, নানা মতাদর্শেরও, কিন্তু নাগরিকের জীবনে জোর-জবরদস্তি খাটাইবার, তাঁহাকে নিয়ন্ত্রণ করিবার প্রশ্নে এই দল ওই দলে, চৌত্রিশ বৎসর বা এক দশকের শাসনকালে প্রভেদ নাই। ক্ষমতায় থাকিলেই, এমনকি হঠাৎ বাড়বাড়ন্ত হইয়া উঠা বিরোধী দলেও নাগরিকের উপর ছড়ি ঘুরাইবার কর্তৃত্ববাদ ঘনাইয়া উঠে। ইহা দলবিশেষের কথা নহে, পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় রাজ্যে এই প্রবণতা দলনির্বিশেষে বহুকাল ধরিয়া আচরিত। উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানার উদগ্র খাপতন্ত্রের দৃষ্টান্ত দেখাইয়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলি সতত নিজেদের সাধু ভাবমূর্তি তুলিয়া ধরে, অথচ তাহারা নিজেরাও ভিন্ন রূপে কিন্তু একই প্রবণতায় দুষ্ট। বিষবৃক্ষের বীজ উপ্ত সব দলের মাটিতেই, সময়ে সময়ে মাথাচাড়া দিতেছে। দ্বিচারিতা বই অন্য কিছু ইহা নহে, নাগরিক ও গণতন্ত্রেরও ইহা চরম অসম্মান। নাগরিকের রাজনৈতিক পরিচিতি-ভিত্তিক শোষণ ও দমননীতি পরিহার না করিলে পশ্চিমবঙ্গও এই অন্যায়তন্ত্রের স্থায়ী ঠিকানা হইয়া দাঁড়াইবে।