Gender

উপেক্ষিতা

শহরের ব্যস্ত মোড় বা উদ্যানবৃত্তগুলি কেবল অঞ্জলিবদ্ধা, প্রণতা বা নৃত্যমুদ্রায় আবিষ্টা নারীমূর্তির প্রহসন-প্রদর্শনেই ভরিয়া থাকিবে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:৩৮

উত্তর ইটালির প্রাচীন ও ইতিহাসঋদ্ধ শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিরাট স্কোয়ারের গা ঘেঁষিয়া ৭৮টি মূর্তি স্থাপিত বহু কাল; প্রতিটিই সেই শহরের ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-পরিসরে কীর্তিমান মানুষের প্রমাণাকৃতি মূর্তি। সম্প্রতি জানা গেল, সেখানে একটিও নারীমূর্তি নাই, সকলই শোভন বিমল পুরুষমূর্তি। ঝুলি হইতে ইতিহাসের উপেক্ষার বিড়ালটি বাহির হইয়া পড়িল কি না, বুঝিতে বুঝিতে এক দল সংস্কৃতি-বিশারদের করা সমীক্ষার ফল জানাইয়া দিল, মূর্তিস্থাপত্যের দেশ ইটালিতে প্রকাশ্য স্থানে নারীমূর্তির সংখ্যা মাত্র ১৪৮, তাহারও মাত্র এক-তৃতীয়াংশের ঠাঁই জনবহুল স্কোয়ারগুলিতে। শুধু তাহাই নহে, সংখ্যায় তাহারও কম নারীমূর্তি বিজ্ঞান বা শিল্পের ন্যায় বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে কীর্তিমতীদের স্থান দিয়াছে, অধিকাংশই হয় ধর্মের মহীয়সীদের, কিংবা মাতা, জায়া, মহিলা শ্রমিকের ন্যায় নারীত্বের আদিকল্পগুলির উদ্‌যাপক।

সত্য প্রকাশ হওয়ায় এখন শোরগোল উঠিয়াছে, বিভিন্ন শহরের পুর-প্রশাসন ও সংস্কৃতি অনুষদগুলি ইটালির ইতিহাসে কীর্তিমতী নারীদের মূর্তি প্রকাশ্য স্থানে বসাইবার তোড়জোড় করিতেছে, দুই-একটি বসানোও হইয়াছে। আবার বিরোধিতার সুরও বাজিতেছে, এত কাল ধরিয়া চোখের সামনে যাহা ছিল তাহাও তো জনমনে ‘ইতিহাস’-এই পরিণত হইয়াছে, উহাকে আবার পাল্টাইবার দরকার কী! সমস্ত তর্ক ও আলোচনা, যুক্তি-প্রতিযুক্তি ছাপাইয়া উঁকি দিতেছে এই প্রশ্ন: সুদূর অতীত নাহয় নারীদের ইচ্ছা করিয়া ভুলিয়া ছিল, সমসময়ও তাহা দেখিল না? দিনের পর দিন, মাস-বৎসর ধরিয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ— রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, পর্যটক, চিন্তকেরা শহরের স্কোয়ার ও অন্য জনবহুল স্থানগুলিতে এই মূর্তিসকল দেখিয়া আসিতেছেন, কাহারও মনে এই প্রশ্নের উদয় হয় নাই যে, এখানে নারীমূর্তির অনুপস্থিতি বড় চোখে লাগিতেছে? পুরুষতন্ত্রের প্রকাশ্য পরাক্রম লইয়া অনেক কথা উঠে, কিন্তু নগরের ঐতিহাসিক স্থাপত্যসম্ভারেও পুরুষমূর্তির রমরমা বুঝাইয়া দেয় জনমনের গভীরেও তাহার শিকড় প্রোথিত, এতই যে শিক্ষিত সংস্কৃত নাগরিকের চোখেও তাহা বিসদৃশ ঠেকে না, কেহ একটি প্রশ্ন পর্যন্ত তুলেন না। আর কেবল মাতৃমূর্তি বা শ্রমক্লান্তা নারীর মূর্তিতে সন্তুষ্ট থাকাও প্রমাণ করে, নারীর ওই ছকবন্দি রূপগুলিই স্থাপত্যে দেখিতে সকলে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে। এই অভ্যস্ততাও কি পুরুষতন্ত্রেরই ‘অবদান’ নহে?

Advertisement

ইটালির শহরের ঘটনা হইতে শিখিবার আছে কলিকাতারও। এই শহরের আনাচে-কানাচে যে পুরাতন মূর্তি-স্থাপত্যগুলি শোভমান, সমীক্ষা করিলে দেখা যাইবে, সেইগুলিরও সিংহভাগ পুরুষমূর্তি। বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ সুভাষচন্দ্র ক্ষুদিরামের মূর্তি যত সংখ্যায় চোখে পড়িবে, তাহার পাশে এক জন বেগম রোকেয়া বা লীলা মজুমদারের মূর্তি চোখে পড়িবে কি? ইন্দিরা গান্ধী, রানি রাসমণি বা মাতঙ্গিনী হাজরার ন্যায় হাতে গোনা মূর্তিস্থাপত্যেই নারীদের প্রতিনিধিত্বের অবসান। ইটালির আলোচ্য শহরটি সপ্তদশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পিএইচ ডি-ভূষিতা নারীর মূর্তি বসাইবার তোড়জোড় করিতেছে। কলিকাতাও কি কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা ভাবিতে পারে না? শহরের ব্যস্ত মোড় বা উদ্যানবৃত্তগুলি কেবল অঞ্জলিবদ্ধা, প্রণতা বা নৃত্যমুদ্রায় আবিষ্টা নারীমূর্তির প্রহসন-প্রদর্শনেই ভরিয়া থাকিবে?

আরও পড়ুন
Advertisement