লাল সঙ্কেত

রিপোর্ট অনুযায়ী, এই শহরের অরণ্য আচ্ছাদনের পরিমাণ মাত্র ১.৮ বর্গ কিলোমিটার— শহরের মোট আয়তনের এক শতাংশেরও কম।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২২ ০৫:৩৯

সতর্কবার্তা ছিলই। জলবায়ু পরিবর্তন লইয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট হইতে স্পষ্ট, এখন বিপদঘণ্টা বাজিয়া গিয়াছে। বিপদ বিশ্বের, এবং সেই বিপন্ন বিশ্বে সর্বাধিক বিপন্ন দেশগুলির মধ্যে ভারত অন্যতম। বিশেষত, এই দেশের শহরাঞ্চল এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে আগাইয়া চলিতেছে। ইহা হইবারই ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রকৃতি এবং মানবজীবন বিপর্যস্ত হইবে, বহু পূর্বেই বিজ্ঞানীরা তাহা অনুমান করিয়াছিলেন। কালক্রমে সেই অনুমান এবং আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করিতেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটিয়া চলা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। প্রসঙ্গত, গত অগস্টে প্রকাশিত আইপিসিসি-র রিপোর্টে জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘কোড রেড’ আখ্যা দেওয়া হইয়াছিল। মানবজাতির লাল সঙ্কেত। সাম্প্রতিক রিপোর্ট প্রমাণ করিল, এই পরিবর্তনের মর্মান্তিক প্রভাব হইতে পরিত্রাণের পথটি ক্রমশ ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর দেখাইতেছে।

ভারতের ক্ষেত্রে বিপদের মাত্রাটি সর্বাধিক মুম্বই, চেন্নাই, কলিকাতার ন্যায় শহরগুলির ক্ষেত্রে। ইতিমধ্যেই পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ এবং অত্যধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাসুল দিতেছে শহরগুলি। আশঙ্কা, ইহার সঙ্গে ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয় যুক্ত হইলে সেই বিপুল ক্ষতি সামলাইবার পরিকাঠামো অধিকাংশ শহরেরই থাকিবে না। সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলি জানাইতেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের উপকূল অঞ্চলে একের পর এক মারণ ঝড় আছড়াইয়া পড়িবার সম্ভাবনা। বৃদ্ধি পাইবে সমুদ্রের জলস্তরও। এবং ভারতের অন্যান্য উপকূলের ন্যায় বাংলার উপকূলও বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। ক্ষতি শুধুই উপকূল অঞ্চলের নহে। আমপান দেখাইয়া দিয়াছে, শহর কলিকাতাও আদৌ সুরক্ষিত নহে। সামুদ্রিক ঝড় তো বটেই, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাইলে কলিকাতার বহু জায়গা জলের তলায় চলিয়া যাইতে পারে বলিয়া আশঙ্কা। এবং জলবায়ু পরিবর্তিত হইলে তাহার প্রভাব শুধুমাত্র পরিবেশের স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকিবে না। জনস্বাস্থ্যের উপরেও পড়িবে। পতঙ্গবাহিত রোগ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাইবে। গত বৎসর কলিকাতায় ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছয় গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছিল। উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আইপিসিসি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, কলিকাতার পাশাপাশি হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলেও ছড়াইবে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া।

Advertisement

অথচ, এমন বিপদের মুখেও প্রশাসনিক স্তরে বিশেষ হেলদোল নাই। এই নিদারুণ নিষ্ক্রিয়তাই যে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপদকে অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছে, তাহা অনস্বীকার্য। কলিকাতাই যেমন। বায়ুদূষণে কলিকাতা দিল্লির তুলনায় খুব পিছাইয়া নাই। অথচ, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট নির্ধারিত সময়ের দুই বৎসর পার করিয়াও জমা পড়ে না। সমস্যা অন্যত্রও। গত বৎসরের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই শহরের অরণ্য আচ্ছাদনের পরিমাণ মাত্র ১.৮ বর্গ কিলোমিটার— শহরের মোট আয়তনের এক শতাংশেরও কম। কেন্দ্রীয় পরিবেশ, অরণ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, এই পরিমাণ দেশের বৃহৎ শহরগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রুখিতে সবুজের ভূমিকা নূতন করিয়া বলিবার নহে। অথচ, উন্নয়নের নামে বেহিসাবি বৃক্ষচ্ছেদন চলিতেছেই। গত এক দশকে যে দ্রুততার সঙ্গে এই শহর সবুজ হারাইয়াছে, সেই হারও দেশের ৭টি বৃহৎ শহরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সুতরাং, এত সতর্কবাণী হইতেও কলিকাতা এবং তাহার প্রশাসন কোনও শিক্ষা লয় নাই। আগামী দুই দশকের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অন্তত দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাইবার আশঙ্কা। বিপন্ন হইবে বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি মানুষ। এই বাংলাও থাকিবে তাহার মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার শুনিতেছে কি?

আরও পড়ুন
Advertisement