ঠিক একশত এক বৎসর আগে প্রমথ চৌধুরী মহাশয় জাতীয়তাবাদ বিষয়ক একটি প্রবন্ধে লিখিয়াছিলেন বাংলার স্বদেশি যুগের বিরাট অবদানের কথা। তাঁহার মূল বক্তব্য ছিল, জাতীয়তাবাদ নামক চিন্তাটিকে রাজনীতির পরিসর হইতে টানিয়া আনিয়া সর্বজনের অঙ্গনে ফেলিয়াছিল স্বদেশি আন্দোলন, এবং সর্বজন তাহাতে নিজ নিজ রং মিশাইয়া জীবনযাপনে মিশাইয়া লইয়াছিল, দেশের ইতিহাসকে ভিন্ন পথে চালিত করিয়াছিল। বাস্তবিক, বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন সমগ্র ভারতের জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে যে কতখানি ‘ফর্মেটিভ’ বা আকারদায়ী ঘটনা, অনেক সাধারণ পাঠ্য ইতিহাস তাহা স্মরণে রাখে না। তবে কিনা, সাধারণ পাঠ্য ইতিহাস অন্তত এইটুকু খেয়াল রাখে, অন্তত এখনও— ১৯০৫ সালে যে আন্দোলনটি হইয়াছিল, তাহা আকারে-প্রকারে অত্যন্ত বিশিষ্ট ছিল, এবং নানা অর্থে পরবর্তী দশকের জাতীয় আন্দোলনসমূহের পথপ্রদর্শক হইয়া উঠিয়াছিল। সেই দশকগুলিতেও অবশ্য বাংলাই জাতীয় আন্দোলনের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিতেছিল— বিপ্লববাদ হইতে অহিংস অসহযোগ, প্রায় সর্ব ক্ষেত্রে। আজকাল অবশ্য সময় অতীব খারাপ পড়িয়াছে, পড়াশোনার অভ্যাস হ্রস্ব হইতে হইতে অবলুপ্ত হইয়াছে, ভূচরাচরমধ্যে রাজনীতিই হইয়া দাঁড়াইয়াছে একমাত্র ধ্যানজ্ঞান-অবধান। কারণে অকারণে মানুষ ‘ইতিহাস’ কপচাইতেছে, অথচ সর্বভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় এমনকি মাধ্যমিক স্তর অবধিও এখন আবশ্যিক বিষয় রূপে ইতিহাস পড়িবার প্রয়োজন হয় না। এ-হেন অশিক্ষাসমুদ্রে অজ্ঞানতিমিরে তাই নেতাগণ ও জনগণ ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার অবদান কী, কতই বা, যত বাড়াবাড়ি’ শীর্ষক আলাপ-আলোচনা চালাইতে পারেন। দেশের উচ্চতম রাজনীতির মঞ্চেও অশিক্ষার প্রলম্বিত ছায়া ভাসিয়া বেড়ায়, মূর্খতার রাজপাট জুড়িয়া স্তাবকসংস্কৃতি শতপুষ্পপত্রে বিকশিত হয়। আশ্চর্য নহে, এমন দেশে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাঁহার ভাষণে বলেন, মাতঙ্গিনী হাজরা হইলেন অসম প্রদেশের সংগ্রামী। আর স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিবসে সরকারি প্রেস-বিজ্ঞপ্তিতে কুর্নিশ জানানো হয়, বিবেকানন্দের ‘অনুপ্রেরণা’জারিত সিপাহি-বিদ্রোহের প্রসঙ্গ তুলিয়া!
এই পরিবেশে বাংলার ট্যাবলো কেন রাজধানীর প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপনে বাদ পড়িবে, কেনই বা নেতাজির একশত পঁচিশতম জন্মবর্ষে তাঁহার প্রদেশের আজাদ হিন্দ ট্যাবলোকে স্থান দেওয়া হইবে না, ইত্যাকার প্রশ্ন বাতুলতা মাত্র। ইহার পিছনে রাজনীতি থাকিতে পারে— দুর্ভাগ্য। ইহার পিছনে রাজনীতি না থাকিয়া নিরীহ অজ্ঞানতা থাকিলে— তাহাও দুর্ভাগ্য। পরাধীন দেশের নাগরিক মনে ও মননে বাঙালি মহানেতার বিপ্লবী চেতনা কী জাদুস্পর্শ বুলাইয়া দিয়াছিল, তাহা অবহিত থাকিলে বাংলাকে এই বৎসর কেবল অংশগ্রহণের স্বীকৃতি নহে, একটি আলাদা বিশেষ স্থান দিবার কথা। কিন্তু এই সবই বৃথা তর্ক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তর্কে ব্যাপৃত হওয়া সময় নষ্ট ছাড়া কিছু নহে। কেবল এইটুকু মনে করাইয়া দেওয়া ভাল, ইতিহাস বাস্তবিক এক অমূল্য পাঠ্যবিষয়। বর্তমানকে জানিবার, বুঝিবার জন্য অতীতের তথ্যনিষ্ঠ জ্ঞান জরুরি। কেননা, যাঁহারা বর্তমানকে একটি বিশেষ রঙে রাঙাইতে চাহেন, তাঁহারা ইতিহাসকে কৌশল ও প্রকৌশল দিয়া তাঁহাদের মতো করিয়া ব্যবহার করেন। অতীত সম্পর্কে অন্তত কিয়ৎ পরিমাণ তথ্যজ্ঞান না থাকিলে ইতিহাস বিস্মরণ করাইবার সেই প্রয়াসের মোকাবিলা করা অসম্ভব।
বাংলার ইতিহাস ভুলিবার, ভুলাইবার এই প্রয়াস নেহাত বেখেয়ালে ঘটিতেছে না। নিতান্ত পাকা হিসাব করিয়াই এ-হেন ‘বিস্মরণ’। আসল কথা, বাংলার রাজনৈতিক নেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র কিংবা তাঁহার গুরু চিত্তরঞ্জন দাশ, ধর্মীয় নেতা শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও স্বামী বিবেকানন্দ, বৌদ্ধিক নেতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— আলাদা আলাদা মত ও পথ সত্ত্বেও এঁরা সকলেই একটি জায়গায় স্পষ্ট, ঋজু এবং আপসবিহীন। সকলকে লইয়া এক সামূহিক মঙ্গলের পথ খুঁজিবার বাসনায় তাঁহারা প্রত্যেকেই আপাদমস্তক স্নাত। সামাজিক বিভেদ দূর করিতে তাঁহারা প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং সেই পথে, প্রয়োজন পড়িলে, বিদ্রোহের উচ্চারণেও অনেকে পিছপা নহেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই নেতারা আজিকার ভারতে বিপদের দূত। মূর্খ-মেথর-দরিদ্র-চণ্ডাল ভারতবাসীর উদ্গাতা কিংবা হিন্দু-মুসলমান-শিখসম্বলিত বাহিনীর হোতাকে যথার্থ ভাবে জানিবার, বুঝিবার ও সম্মান প্রদর্শন করিবার ক্ষেত্রে চরম অনীহাটি সেই কারণেই।