ফাইল চিত্র।
ওমিক্রন শেষ অবধি কোভিডের তরঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হইবে, না কি তাহা অতি বিপজ্জনক, কিন্তু তুলনায় ক্ষণস্থায়ী হড়পা বানের সহিত তুলনীয় হইবে, এই তর্ক চলিতে থাকিবে। কিন্তু, সাবধানতার যে বিকল্প নাই, তাহা তর্কাতীত। প্রশ্ন হইল, সেই সাবধানতার রূপটি কী প্রকার? মুখ্যমন্ত্রীদের সহিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বড় মাপের লকডাউনের বিরুদ্ধে সওয়াল করিয়াছেন। অতিমারির সহিত লড়াইয়ে অর্থব্যবস্থা যেন উলুখাগড়া না হয়, সে কথা তিনি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। অবিবেচনাপ্রসূত লকডাউন কী ক্ষতি করিতে পারে, প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানিবেন। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এখনও ২০২০ সালের লকডাউনের দীর্ঘ ছায়া অতিক্রম করিতে পারে নাই। বারে বারেই বোঝা গিয়াছে যে, দেশ জুড়িয়া এই মাপের লকডাউন করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে যতখানি ভাবনাচিন্তা আবশ্যিক ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তাহার কিছুই করে নাই। এই দফায় প্রধানমন্ত্রী তেমন হঠকারিতার কথা ভাবিতেছেন না, তাহা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করিতে পারে। ভাইরাস, না কি তাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের দানবিক প্রতিরোধ, কোনটির পরিণাম ভয়ঙ্করতর, এখনও সেই প্রশ্নের কোনও নির্ণায়ক উত্তর নাই। কিন্তু, গত দুই বৎসরের লাভ-ক্ষতির তুল্যমূল্য হিসাব বলিতেছে যে, সত্যই সার্বিক লকডাউনের প্রয়োজন নাই।
তাহা হইলে অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ হইবে কোন অস্ত্রে? প্রথম অস্ত্রটির নাম সুবিবেচনা ও কাণ্ডজ্ঞান। যখন অতিমারি ছড়াইতেছে, তখন মেলা বা জনসমাগম করিতে দিলে তাহা যে ‘সুপারস্প্রেডার’ হইয়া উঠিতে পারে, এই কথাটি বিস্মৃত হইলে চলে না। গঙ্গাসাগরে মেলার ক্ষেত্রে কথাটি যতখানি সত্য, রামদাসজয়ন্তীর জন্যও ততখানিই সত্য। আবার, কোভিডের প্রাবল্যের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনেও সেই একই অবিবেচনা রহিয়াছে। সিদ্ধান্তগুলি রাষ্ট্রীয়— হয় সরকারের, নয় কোনও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের। ফলে, এই অবিবেচনার দায় শেষ অবধি রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। অতিমারি ছড়াইয়া পড়িবার পূর্বে তাহাতে রাশ না পরাইলে শেষ অবধি লকডাউনই যে নির্বিকল্প অস্ত্র হইয়া উঠে, এই কথাটি ভারত বহু মূল্যে শিখিয়াছে। বস্তুত, অতিমারিকে উপেক্ষা করিয়া বিভিন্ন গোত্রের সুপারস্প্রেডার চালাইয়া যাইবার সিদ্ধান্ত যাঁহারা গ্রহণ করেন, এবং তাহার পরিণতিতে যাঁহাদের সমস্যায় পড়িতে হয়, উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে ইনসেনটিভ বা প্রণোদনার ফারাক দুস্তর— সেই কারণেই প্রকৃত সদিচ্ছা ব্যতীত অন্য কোনও পথ নাই এই সুবিবেচনাকে রাষ্ট্রীয় অবস্থানের অঙ্গ করিয়া তুলিবার, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের যুক্তি করিয়া তুলিবার।
দ্বিতীয় অস্ত্রটির প্রয়োগ অতিমারির বিরুদ্ধে নহে, তাহার অর্থনৈতিক ভয়াবহতার বিরুদ্ধে। অতিমারি সব ক্ষেত্রের সমান ক্ষতি করে নাই। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র যেখানে বহুলাংশে অক্ষত, পর্যটন ক্ষেত্র সেখানে শুইয়া পড়িয়াছে, হোটেল ব্যবসা প্রবল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। নির্মাণক্ষেত্র হইতে সংগঠিত খুচরা বিপণন, এক একটি ক্ষেত্রের উপর অতিমারির প্রভাব এক এক রকম। এই ক্ষেত্রগুলির সহিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বহু মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। ফলে, শুধু অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের কথা ভাবিয়াই নহে, সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ আর্থিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করিয়াও এই ক্ষেত্রগুলির প্রতি নজর দেওয়া সরকারের কর্তব্য। শুধু ঋণের প্রতিশ্রুতি, অথবা প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ বা উৎপাদন-ভিত্তিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করিলেই হইবে না, কোন ক্ষেত্রে ঠিক কী প্রয়োজন, তাহা জানিয়া লইয়া সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে। সার্বিক লকডাউন না করিবার সিদ্ধান্তটিই অর্থব্যবস্থাকে গতিশীল করিবার জন্য যথেষ্ট নহে— ক্ষেত্রভিত্তিক সুবিবেচনার প্রকাশ আবশ্যক। নচেৎ, ভাইরাসের মারণলীলা যদি থামেও, অর্থব্যবস্থার প্রলয় বন্ধ হইবে না।