Election

জয়-পরাজয়

উপনির্বাচনে সচরাচর ভোট শাসক দলের পক্ষেই যায়— এই উপনির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরও কোনও কোনও মহল থেকে সে যুক্তিটিই ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:১৭

পশ্চিমবঙ্গে ছ’টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে প্রতিটিতেই তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীদের জয়ের ঘটনাটিকে ঠিক কতখানি গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়? উপনির্বাচনে সচরাচর ভোট শাসক দলের পক্ষেই যায়— এই উপনির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরও কোনও কোনও মহল থেকে সে যুক্তিটিই ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যুক্তিটি ভ্রান্ত— পশ্চিমবঙ্গেই সাম্প্রতিক কালের এক উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী— পরে অবশ্য তিনি দল পাল্টে যোগ দেন তৃণমূল কংগ্রেসে। অতএব, উপনির্বাচন মাত্রেই শাসক দলের প্রার্থী জিতবেন, এমন সরলরৈখিক সম্ভাবনাকে ধ্রুব জ্ঞান করার যুক্তি নেই। এই উপনির্বাচনের ফলাফলকে গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে আরও বড় কারণটি হল, এই নির্বাচন হয়েছে আর জি কর-কাণ্ডের পটভূমিকায়। রাজ্য রাজনীতির স্নায়ুকেন্দ্র কলকাতায় যে বিপুল আন্দোলন কর্মসূচি চলল তিন মাস ধরে, উপনির্বাচনের ফলাফলে তার কী ও কতখানি প্রভাব পড়তে পারে, সে প্রশ্ন যে কোনও রাজনীতি-জিজ্ঞাসুর কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেল, প্রভাব নেই, কিংবা ঋণাত্মক। কারণ সম্ভবত দু’টি। প্রথমত, আন্দোলনটি ক্রমশ চিকিৎসকদের নিজস্ব দাবিদাওয়া-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় বৃহত্তর জনসমাজে সম্ভবত তার অভিঘাত কমেছে। রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসের অপ্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত— এই নির্বাচনে একা লড়ে কংগ্রেস তা আরও স্পষ্ট করে দিল— পাশাপাশি দেখা গেল, বামপন্থী দলগুলিও সমাজমাধ্যমের পরিসরে যে জনসমর্থন পায়, তাকে ভোটে রূপান্তরিত করার পথ তাদের জানা নেই।

Advertisement

নির্বাচনের ফলাফলে আরও বেশি ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। অপ্রত্যাশিত নয়। মার্চে সন্দেশখালি পর্বে বিজেপি কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছিল তার রাজনৈতিক সুফল ঘরে তুলতে; অগস্টের আর জি কর-কাণ্ডে একটি মিছিল ব্যতিরেকে তারা মাঠের বাইরেই থেকেছে, বা থাকতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু, কোনও ক্ষেত্রেই শাসক দলের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত রাজনৈতিক ক্ষোভকে বিজেপি নিজেদের পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ ভোটে পরিণত করতে পারেনি। কেন, সে প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই রাজ্যে সে দলের সাংগঠনিক শক্তিহীনতার কথা বলতে হয়। কোনও আঞ্চলিক ক্ষোভকে রাজ্যব্যাপী রাজনৈতিক ঝড়ে পরিণত করার দক্ষতা ও সামর্থ্য পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির দৃশ্যত নেই। রাজ্যে এত দিন তাদের যে বিস্তার ঘটেছে, তা ঘটেছে মূলত সাম্প্রদায়িক বিভাজিকা অনুসারেই। একটি অংশের মধ্যে তাদের প্রভাব যথেষ্ট, কিন্তু সেই অংশটি ক্রমবর্ধমান কি না, প্রশ্ন সেখানেই। সম্ভবত, নিচু ডালের ফল সংগ্রহের পরে ঝুড়িতে অন্য কিছু তোলার জন্য যে রাজনৈতিক কল্পনাশক্তি চাই, বিজেপির তা নেই।

ছয় কেন্দ্রে প্রশ্নাতীত জয়লাভের পরে তৃণমূল নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে স্বস্তির শ্বাস ফেলছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি মানুষ বিশ্বাস করেননি, এবং শাসক হিসাবে তাঁদের বৈধতাকে স্বীকার করেছেন— তৃণমূল নেতৃত্ব বিভিন্ন ভাবে এই কথাটি বোঝাতে চাইবেন। এ কথা ঠিক যে, দুর্নীতি ও অত্যাচারের যাবতীয় অভিযোগ সত্ত্বেও এই ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের সিংহভাগ ভোটার তাঁদেরই ভোট দিয়েছেন। কিন্তু, তা কি বৈধতার স্বীকৃতি? না কি, মানুষ দলের অত্যাচারের চেয়ে সরকারের প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরভিত্তিক উন্নয়ননীতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন? মানুষ শাসক দলের নেতা ও বাহুবলীদের অত্যাচারকে একটি বিরক্তিকর কিন্তু অনিবার্য যন্ত্রণা হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও সেই অত্যাচারকে বৈধ বলে মেনে নিয়েছেন বলে দাবি করা মুশকিল। কেউ এই প্রশ্নও করতে পারেন— শাসক দলের বিবিধ অত্যাচারে যাঁরা গর্জে উঠেছিলেন, এবং এ বার যাঁরা তৃণমূল প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন, তাঁরা কি একই জনগোষ্ঠী? প্রশ্নগুলি থাকছে। আপাতত নিশ্চিন্ত শাসকরা স্মরণে রাখতে পারেন— রাজধর্ম থেকে চ্যুতি শেষ অবধি অক্ষমণীয় হয়ে দাঁড়ায়। সেই সীমাটিকে এখনও যত দূরে মনে হচ্ছে, প্রকৃত দূরত্ব সম্ভবত তার চেয়ে ঢের কম।

আরও পড়ুন
Advertisement