শীতকাল এবং চিন-যোগ। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আপাতত এই দু’টি শব্দই কাঁপন ধরানোর পক্ষে যথেষ্ট। বাস্তবে হয়েছেও তাই। সম্প্রতি তুমুল চর্চিত বিষয়টির নাম এইচএমপিভি ভাইরাস। চিনে এটির একটি রূপ সংক্রমণের মাত্রা লক্ষণীয় ভাবে বৃদ্ধি করেছে। ভারতেও নানা প্রান্ত থেকে সংক্রমণের খবর মিলেছে। সুতরাং, করোনাপীড়িত মানুষ এখনই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। দেশে ফের লকডাউন-এর মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে কি না, বিভিন্ন আলোচনায় সেই প্রসঙ্গও উঠে আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রক এবং বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, করোনার মতো এই ভাইরাসও যে বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী, তেমনটা মনে করার কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি। ভাইরাসটি এ দেশে নতুনও নয়। প্রতি বছর শীতকালীন সর্দি-কাশির প্রকোপ বৃদ্ধির পিছনে অনেকাংশে এর ভূমিকা দেখা যায়, যা সাধারণত ঘরোয়া চিকিৎসাতেই সেরে যায়। দেশে এখনও পর্যন্ত সংক্রমণের যে প্রমাণ মিলেছে, তার পিছনে চিনের ভাইরাসের কোনও ভূমিকা নেই। তাই আতঙ্ক নয়, সতর্ক থাকা জরুরি।
তবে, ভয় নিতান্তই অযৌক্তিক নয়। অতিমারির বিভীষিকা থেকে এখনও মানুষ পুরোপুরি বেরোতে পারেননি। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া, মৃত্যুমিছিল, পরিকল্পনাহীন লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, অনলাইন-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় এক বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হওয়া— অনেক কিছুরই সাক্ষী তাঁরা। কোভিড-উত্তর অর্থনীতি এখনও তার জড়তা কাটিতে উঠতে পারেনি। এবং এ দেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও এমন কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের দেখা মেলেনি, যাতে আশ্বাস মিলতে পারে ফের মহামারি, অতিমারি এলে সে ধাক্কা সহজে সামলে ওঠা যাবে। আসলে অতিমারি এ দেশের জনমনে এক বিরাট আস্থাহীনতার সৃষ্টি করেছে। প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা। সে ব্যবস্থার খোলনলচে না পাল্টালে আস্থা ফেরা কঠিন। তেমন উদ্যোগ কি সক্রিয় ভাবে সরকার এখনও দেখিয়েছে? অন্য দিকে, ভাইরাস সম্পর্কে চিন থেকেও সবিস্তার তথ্য মেলেনি। এখনও জানা যায়নি তাদের হাসপাতালে ভর্তির হার, অক্সিজেনের প্রয়োজনের মাত্রা। তথ্যের এই অস্পষ্টতা কোভিডের প্রথম পর্বেও দেখা গিয়েছিল। ফলে ভাইরাসের চরিত্র চিনতে অনেক দেরি হয়ে যায়। জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ে এটাও ছিল অন্যতম কারণ।
স্বস্তির কথা, এখনও পর্যন্ত এইচএমপিভি-কে সেই গোত্রে ফেলা যায়নি। শীত এবং বসন্তের সময়টিতে এমনিতেই নানাবিধ ভাইরাসের আনাগোনা লেগেই থাকে। শিশু, বয়স্ক এবং জটিল রোগাক্রান্তদের ক্ষেত্রে সেই সংক্রমণও মাঝেমধ্যে জটিল হয়ে ওঠে। দূষণের মাত্রাবৃদ্ধি এবং উষ্ণায়নের দাক্ষিণ্যে ভাইরাসের চরিত্রবদলও অজানা বিষয় নয়। সুতরাং, দৈনন্দিন যাপনে পরিবর্তন জরুরি। কোভিডের সময় যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কথা বলা হত, যেমন— মাস্ক পরা, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, অসুস্থ হলে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা— এগুলি কোনওটাই কঠিন কাজ নয়। বরং এর মধ্যে দিয়েই একটি সাধারণ সংক্রামক রোগের অ-সাধারণ হয়ে ওঠা ঠেকানো যায়। সুতরাং, সরকারি নির্দেশিকার আগেই নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থাটি পোক্ত করা বাস্তববোধের পরিচায়ক। মনে রাখা প্রয়োজন, সংক্রামক ব্যাধির সম্মুখে আতঙ্কিত হওয়া বা উপেক্ষা করা— উভয়ই সমান ক্ষতিকর।