শেষ পর্যন্ত ভোডাফোনের বৃহত্তম অংশীদার হইল কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের নিকট ঋণের বোঝা শোধ করিতে অসমর্থ সংস্থাটির সম্মুখে এই দরজাটি খুলিয়া দিয়াছিল কেন্দ্র— ভোডাফোন তাহাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে। বহুজাতিক ভোডাফোন বা তাহার ভারতীয় অংশীদার আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠী, কেহই ডুবন্ত সংস্থায় নূতন লগ্নি করিতে সম্মত না হওয়ায় আর কোনও উপায়ও ছিল না। প্রশ্ন হইল, সরকারের সম্মুখেও কি আর উপায় ছিল না? কোনও সংস্থা সরকারের পাওনা মিটাইতে না পারিলেই কি সরকার তাহার অংশীদার হইয়া উঠিতে পারে? উত্তরে কেহ বলিবেন, সরকার যদি ভোডাফোন সংস্থাটিকে বাঁচাইতে উদ্যোগী না হইত, এবং তাহার ফলে সংস্থাটি যদি শেষ অবধি বন্ধ হইয়া যাইত, তবে এই সময়ে আরও বহু মানুষ কর্মচ্যুত হইতেন। এই ভয়াবহ সময়ে সেই পরিণতি হইতে অর্থব্যবস্থাকে রক্ষা করা সরকারেরই দায়িত্ব। ফলে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যাহা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য, বর্তমান সময়ে প্রয়োজন হইলে তেমন পদক্ষেপ করা জরুরি হইতে পারে। তবে, অংশীদারি গ্রহণের অর্থ ইহা নহে যে, সরকার সংস্থাটির পরিচালনার কাজে হস্তক্ষেপ করিতে পারে। এখনও অবধি জানা গিয়াছে যে, সংস্থাটি যে ভাবে পরিচালিত হইত, তেমনই চলিবে। এই ব্যবস্থাই বজায় রাখা বিধেয়। এবং যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে নিজের শেয়ার বেচিয়া দিতে হইবে। যে কাজ সরকারের নহে, দীর্ঘমেয়াদে সেই কাজে জড়িত না থাকাই বিধেয়।
শুধু কিছু লোকের চাকুরি বাঁচানোই অংশীদারি গ্রহণের একমাত্র কারণ, বলিলে সম্ভবত অর্ধসত্য কথন হইবে। ভারতের টেলিকম ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে তিনটি বেসরকারি সংস্থা ব্যবসা করিতেছে; সরকারি টেলিকম সংস্থা বিএসএনএল-ও আছে, কিন্তু সরকারি পরিচালনার কল্যাণে তাহার অবস্থা ‘ছায়ার মতন, আছি না আছি’। তাহার মধ্যে ভোডাফোনের ঝাঁপ পড়িয়া গেলে থাকিত কার্যত দুইটি মাত্র সংস্থা— অর্থশাস্ত্রের ভাষায়, টেলিকমের বাজারে একটি ডুয়োপলি সৃষ্টি হইত। তাহা গ্রাহকের পক্ষে অতি ভয়ঙ্কর। এই পরিস্থিতির পিছনে সরকারের দায় অনস্বীকার্য। এক দশক পূর্বেও দেশের টেলিকম-বাজারে অনেকগুলি সংস্থা ছিল। কমিতে কমিতে এখন তিনটিতে আসিয়া ঠেকিয়াছে, তাহার প্রধানতম কারণ হইল, ভারতের টেলিকম-বাজার বিশ্বের দুরূহতম বাজারগুলির একটি। অতিরিক্ত এবং অবিবেচিত কর আদায়, লাইসেন্স বাতিল, এবং বিধির অনিশ্চয়তা বাজারটিকে ক্রমশ দুরধিগম্য করিয়াছে। তাহারই অনিবার্য ফল বর্তমান পরিস্থিতি, যেখানে একটি সংস্থাকে বাঁচাইতে সরকারকে তাহার বৃহত্তম অংশীদার হইয়া উঠিতে হয়।
এর পরও পরিস্থিতি পাল্টাইবে কি না, সেই নিশ্চয়তা নাই। বারে বারেই অভিযোগ উঠিয়াছে যে, একটি নির্দিষ্ট শিল্পগোষ্ঠীর টেলিকম সংস্থাকে বাড়তি সুবিধা করিয়া দিবার জন্য সরকার এই বাজারের সমতাকে নষ্ট করিয়াছে। অবশ্য, কথাটি শুধু টেলিকম ক্ষেত্রের জন্যই প্রযোজ্য, বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। সাঙাততন্ত্রের কবল হইতে বাজার ব্যবস্থাকে উদ্ধার করা যাইবে কি না, এই মুহূর্তে তাহাই বৃহত্তম প্রশ্ন। তিনটি বৃহৎ সংস্থা টিকিয়া থাকিলে বাজারে প্রতিযোগিতা বজায় রাখিতে সমস্যা হইবে না। কিন্তু, তাহার জন্য বেসরকারি লগ্নি প্রয়োজন। এবং, লগ্নিকারীরা সরকারের নিকট কিছু সঙ্কেতের প্রত্যাশা করেন। যথা, সরকার বুঝাইয়া দিবে যে, টেলিকমের বাজার হইতে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা হইবে না; অথবা, কোনও একটি গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের পক্ষপাতিত্ব থাকিবে না। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম টেলিকম বাজার। লগ্নিকারীরা যখন এমন বাজার হইতেও দূরে থাকিতে চাহেন, তখন বুঝিতে হয় যে, অসুখ গভীর। তাহার আশু চিকিৎসা প্রয়োজন। সরকারকে সেই কাজটিই করিতে হইবে।