প্রতীকী ছবি।
চাষিদের জন্য ধানের লোভনীয় সহায়ক মূল্য ঘোষণা করিয়াছে সরকার— কিন্তু অভিজ্ঞতা বলিতেছে যে, তাহা পাইবার উপায় নাই চাষির। অভিযোগ, চালকল মালিক এবং আড়তদারদের চক্র প্রান্তিক চাষিদের ধান যৎসামান্য দামে কিনিয়া নানা কৌশলে সরকারকে বিক্রয় করিতেছে। ধান উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে নানা জেলা হইতে চাষিদের অভিযোগ উঠিয়া আসিয়াছে সংবাদে— সরকার ধান কিনিবার ঘোষণা করিলেও শিবির শুরু করে নাই, তাই অভাবী বিক্রয় শুরু হইয়ছে। ধান সত্বর বিক্রয় না করিলে ছোট চাষির ঋণ শোধ হইবে না, পরবর্তী চাষের টাকাও সংগ্রহ হইবে না— ফলে আড়তদারদের উপর নির্ভর করিতে বাধ্য হইতেছেন চাষি। অনেকে তবুও সরকারকে বিক্রয়ের আশা ছাড়েন নাই। নানা জায়গায় চাষিরা ধান বিক্রয়ের ‘কুপন’ পাইতে দীর্ঘ লাইনে বসিয়া আছেন। অনেকে জাগিয়া রাত কাটাইতেছেন। তাঁহাদের মাথায় হেমন্তের হিম, তাঁহাদের হৃদয়ে কেবলমাত্র প্রতারিত না হইবার আশা। আক্ষেপের কথা ইহাই যে, বিস্তৃত দুর্নীতির জালকে অস্বীকার করিয়া সরকার কার্যত ইহাকে অবাধে চলিবার সুযোগ করিয়া দিতেছে। চাষিদের প্রাপ্য মূল্য অন্যরা ফাঁকি দিয়া লইতেছে, চাষি অসহায়।
এই ক্ষতি কেবল চাষির নহে, করদাতারও। কুইন্টাল-প্রতি সহায়ক মূল্য প্রতি বৎসর বাড়িতেছে। রাজ্যে উৎপন্ন ধানের অন্তত ৩০ শতাংশ ক্রয় করে সরকার— খরিফ মরসুমে ফসল কিনিতে এই বৎসর বরাদ্দ হইয়াছে নয় হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থের প্রধান উদ্দেশ্য অভাবী বিক্রয় বন্ধ করা, যাহাতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি ক্ষতি এড়াইতে পারেন। মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষককে ফাঁকি দিয়া যদি এই সুবিধাটির অপব্যবহার করিয়াই চলেন, যদি ওই অর্থ প্রকৃত উৎপাদকের নিকট পৌঁছাইতে না-ই পারে, তাহা হইলে বৎসরের পর বৎসর এই বিপুল অর্থ বরাদ্দ করিয়া কী লাভ? সরকারি ক্রয় বাজারদরে প্রভাব ফেলিতে পারে না, তাহা স্পষ্ট— গত পাঁচ-সাত বৎসরে খোলা বাজারে ধানের পাইকারি দাম বাড়িয়াছে অতি সামান্য। অথচ, ধানের উৎপাদন খরচ অতি উচ্চ হারে বাড়িয়াছে। অভাবী বিক্রয়ে বাংলার ছোট চাষি যত ক্ষতি স্বীকার করিতেছেন, তাহার অর্থমূল্য সরকারি সহায়তার অঙ্ককে বহু গুণ ছাড়াইয়া যাইবে।
করদাতার অর্থের এমন অপচয় কী করিয়া চলিতেছে? প্রথম কারণটি সুবিদিত— যাঁহারা এই দুর্নীতির মূল কান্ডারি, তাঁহাদের প্রত্যেকের মাথাতেই রাজনীতির আশীর্বাদি হাত আছে। বিরোধী দলের নেতারাও সরকারকে বিঁধিতে যত উৎসাহী, চাষির অধিকারের সুরক্ষায় ততখানি নহেন। কেন, সেই ব্যাখ্যা খুব জটিল হইবে না। দ্বিতীয় কারণটি নাগরিক সমাজের অনুসন্ধান-অনীহা। সহায়ক মূল্যে চাষির অধিকার লইয়া শিক্ষিত সমাজ যত সরব, সহায়ক মূল্যের কার্যকারিতা লইয়া বিচারে ততই নিরুৎসাহ। রাজকোষ হইতে নিরন্তর অর্থব্যয় হইতেছে, অথচ তাহার সুফলের ছিটাফোঁটাও ক্ষুদ্র দরিদ্র কৃষকের নিকট পৌঁছাইতেছে না, এই পরিস্থিতিটি নাগরিক সমাজকে যথেষ্ট বিচলিত করিতে পারে নাই। সুযোগসন্ধানী রাজনীতি এই অসচেতনতার সুযোগ লইতেছে। যে কোনও অধিকারকে অনুগ্রহে পরিণত করিতে নেতা-নেত্রীদের জুড়ি নাই। তাই বাংলার চাষি হইয়াছেন ধান বিক্রয়ের কুপন-প্রার্থী। হেমন্তের হিম মাথায় করিয়া তাঁহারা লাইনে রাত জাগিতেছেন।