আর একটি ভয়ঙ্কর কলঙ্ক যু্ক্ত হল পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে। এ বারের বাংলা নববর্ষের দিনটি এই ভেবেই শুরু করতে হচ্ছে যে, দেশেবিদেশে আপাতত মুর্শিদাবাদ কাণ্ড সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের সঙ্কট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অথচ, সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও অশান্তি সত্ত্বেও রাজ্যের হিন্দু-মুসলমান চিত্র মোটেই এত ভয়ানক ও বিপজ্জনক নয়, এ কেবল একটি ছোট অংশের অসহিষ্ণু উগ্র হিংসার বিস্ফোরণের ছবি। কিন্তু যখন একটি ছোট জায়গাতেও এক সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের উপর এমন ভয়াল আক্রমণ করেন, জনমানসে তা রাজ্যের সমগ্র ছবিটিকেই বিনষ্ট করে দিতে পারে, ভুলিয়ে দিতে পারে যে পশ্চিমবঙ্গে বিরাট সংখ্যালঘু সমাজ কিন্তু আসলে যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ। সমন্বয় ও সহযোগিতার চিহ্ন এই রাজ্যে যথেষ্ট সবল ও স্পষ্ট। ভুলিয়ে দিতে পারে যে, বহু বিচিত্র উস্কানিতেও এই বাংলার সাধারণ মানুষ বিচলিত ও বিপথচালিত হন না, বোধ বুদ্ধি ধৈর্য ও বিবেচনার পরিচয় দিয়ে সদর্থক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাই মুর্শিদাবাদেও একটি ছোট অঞ্চলের বাইরে স্বাভাবিক জীবনের হানি হয় না। গোটা ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক উস্কানির কথা বারংবার ধ্বনিত হচ্ছে। বহিরাগত যোগের কথাও শোনা যাচ্ছে। এক দিকে প্রতিবেশী দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী জেলা মৌলবাদী হিংসার দ্রুত প্রসার, অন্য দিকে রাজ্যে মেরুকরণের আবহে সংখ্যাগুরুবাদের কুপ্ররোচনা— সহজেই বোধগম্য। কিন্তু এর পরও একটা কথা থাকে। যে স্থানে এত যুগ ধরে নানা সম্প্রদায়ের মানুষ সহাবস্থান করেন, সেখানে এমন উস্কানি আটকানো যায় না কেন? কেন ধর্মের নাম নিয়ে দুষ্কৃতীরা নিধন, অত্যাচার, ভীতিপ্রদর্শনের সুযোগ পায়? ওই জেলার এবং বাকি রাজ্যের সমস্ত শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকের কাছে প্রত্যাশা, তাঁরা সাধ্য অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিবেশী মানুষকে নিরাপত্তা দেবেন, সাহস জোগাবেন। বাংলার সহনের সংস্কৃতি, রবীন্দ্র-নজরুল, চৈতন্য-লালন থেকে যদি তাঁরা কিছু শিখে থাকেন, তা হলে এখনই হিংসা পরিহার করবেন, হিংসা রোধ করবেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে যতই ক্ষোভ থাকুক, এই পথে তার মীমাংসা সম্ভব নয়।
এবং, রাজ্য প্রশাসনের কাছে দাবি, যারা তবু হিংসা ও দুষ্কৃতির পথেই থাকতে চাইবে, তাদের বিরুদ্ধে যেন অবিলম্বে নির্বিচার ও কঠোর পদক্ষেপ করা হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে এক বিন্দু বিচ্যুতি সহনীয় নয়। বিভিন্ন বিরোধী পক্ষ থেকে সঙ্গত প্রশ্নই উঠেছে যে, রাজ্য সরকার যদি সেই নীতি সত্যিই মেনে চলত, তা হলে কী ভাবে ইতিমধ্যে এত মানুষ গৃহছাড়া সংস্থানহারা হলেন? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি বুঝতে পারছেন যে, মুর্শিদাবাদ-ঘটনা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হয়ে রইল? কেন্দ্রীয় বাহিনীর সহায়তা মিলেছে, এর পর রাজ্যে শান্তি স্থাপনের পথে কোনও বাধাই থাকতে পারে না। প্রসঙ্গত, সরকার না চাইলেও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হতে পারে, কিন্তু সরকার চাইলে সেই সংঘর্ষ বন্ধ হবেই। বিশ ও একুশ শতকের ইতিহাস সেই শিক্ষাই দিয়েছে।
শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বিপক্ষে কোন অভিযোগের ভিত্তি কতখানি, ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে দু’টি কথা তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই বলা যায়। ভোটরাজনীতির উন্মত্ততায় রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি বর্তমানে যে পথে হাঁটছে, তা অচিরে গোটা বাংলাকে দগ্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। উস্কানিদাতা বিরোধী এবং নিষ্ক্রিয় শাসকের কি তবে সেটাই লক্ষ্য? দ্বিতীয়ত, সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম পাল্লা দিয়ে দেখাচ্ছে, রাজনীতিকরা এই সুযোগটি পাচ্ছেন কেননা সমাজের একাংশ ধর্মীয় বিদ্বেষ ও ঘৃণাকে ফেনিল ঘূর্ণির মতো পাকিয়ে তুলতে উদ্যত। শতাধিক বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ছিদ্র না থাকলে শনি প্রবেশ করতে পারে না। এই অংশের সমাজই সেই ছিদ্রপথ। পশ্চিমবঙ্গের বাকি মানুষের কাজ এখন, সর্বশক্তি দিয়ে ছিদ্রটি রোধ করা।