Sarada Muraleedharan

কৃষ্ণগহ্বর

গাত্রবর্ণ নিয়ে ভারতের যে গভীর ও ব্যাপক বিদ্বেষ কাজ করে, তা ফের মনে করিয়ে দিয়েছে সারদার কথাগুলি। স্বভাবতই তা সমাজমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, মন্তব্যের ঝড় তুলেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫ ০৫:২৭

আজও ভারতে গায়ের রং দিয়ে মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয়, মনে করালেন কেরলের মুখ্য সচিব সারদা মুরলীধরন। সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট-এ তিনি লিখেছেন, তাঁর কাজ সম্পর্কে এক জন মন্তব্য করেছেন, তাঁর কাজ ততটাই কালো যতটা তাঁর স্বামীর কাজ ছিল সাদা। সারদার পূর্বে তাঁর স্বামী ছিলেন কেরলের মুখ্য সচিবের পদে, ঘটনাক্রমে তাঁর গায়ের রং কালো নয়। এখানে স্পষ্টতই ‘কালো’-র সঙ্গে নিম্ন মেধা, নিম্ন স্তরের যোগ্যতা, এবং শ্বেতাভ রঙের সঙ্গে কাজে ও দক্ষতায় উৎকর্ষকে সমান করে দেখা হয়েছে। এক কথায়, ফর্সা মানে ভাল, কালো মানে খারাপ, কালো মেয়ে মানে অনন্ত দুর্ভাগ্য। সারদা লিখেছেন, কালো কেবল একটা রং নয়, কালো মানে যার দ্বারা কিছু হওয়ার নয়, কালো যেন একটা রোগ, অন্ধকারের কেন্দ্রস্থলের আলোহীনতা। এর শিকড় লুকিয়ে বর্ণবিদ্বেষে, তা-ও উল্লেখ করেছেন সারদা। নিম্নবর্ণ, দলিত-জনজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যেই কৃষ্ণবর্ণের আধিক্য, তাই জাতপাতের বিদ্বেষ প্রকাশ হওয়ার অন্যতম মাত্রা কালো রঙের প্রতি তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা, ঘৃণা। তার সঙ্গে লিঙ্গবিদ্বেষ যুক্ত হলে সমাজের পীড়ন কোন পর্যায়ে পৌঁছয়, তা একটি রাজ্যের মহিলা মুখ্যসচিবের কথায় নতুন করে উঠে এল। ঊনষাট বছর বয়সি সারদা বলেছেন, তাঁর নিজের রং নিয়ে যে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, কালোও যে সুন্দর হতে পারে, কালোকে ভালবেসে গ্রহণ করা যেতে পারে, সে কথা নিজেকে বোঝাতে তাঁর পঞ্চাশ বছর লেগে গিয়েছে। নিজের সন্তানরা তাঁকে বুঝিয়েছে, তিনি আদরণীয়া, রূপলাবণ্যময়ী।

Advertisement

গাত্রবর্ণ নিয়ে ভারতের যে গভীর ও ব্যাপক বিদ্বেষ কাজ করে, তা ফের মনে করিয়ে দিয়েছে সারদার কথাগুলি। স্বভাবতই তা সমাজমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, মন্তব্যের ঝড় তুলেছে। ভারতের অগণিত মেয়ের মনে জমে-থাকা অপমান বোধ, বেদনার প্রকাশ ঘটেছে সে সব মন্তব্যে। প্রাতিষ্ঠানিক সম্মানে সারদা শীর্ষের কাছাকাছি— তিনি আইএএস, একটি রাজ্যের মুখ্য সচিব। তাঁর প্রতিও অনাস্থা, তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা চলে তাঁর গাত্রবর্ণ নিয়ে, এ থেকে আন্দাজ হয় যে বিত্তহীন, রোজগারহীন মেয়েদের অভিজ্ঞতা কী ভয়ানক। বাড়িতে নিকটজনদের আক্ষেপ, বাইরে তাচ্ছিল্য, নিন্দা, উপেক্ষা, এর মধ্যে দিয়েই মেয়েরা বড় হয়। ভারতে ফর্সা হওয়ার প্রসাধনীর বিপুল বাজার। দু’তিন দশক আগে ফর্সা রঙের প্রেমিক পাওয়া, বর পাওয়ার শর্ত বলে দেখা হত। সমালোচনা এড়াতে এখন তা-ই সাফল্যের শর্ত বলে প্রচার করা হচ্ছে বিনোদনে, বিজ্ঞাপনে।

গাত্রবর্ণ-বিদ্বেষ এতই ‘স্বাভাবিক’ যে তা নজরে আসে না। ভারতে একটি কালো মেয়ে বড় হতে হতে কোথাও তার মতো পুতুল, মডেল, নায়িকা খুঁজে পায় না। আপনিই তার মনে ধারণা জন্মে যায়, সে ‘ভুল’ গায়ের রং নিয়ে জন্মেছে। কত শৈশবে একটি মেয়ের মধ্যে গাত্রবর্ণ নিয়ে হীনতার বোধ জন্মাতে পারে, তা-ও লিখেছেন সারদা। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি নিজের মাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি কি আবার মেয়েকে গর্ভে ঢুকিয়ে ফর্সা করে বার করতে পারেন না? একটি শিশু নিজের পুনর্জন্ম কামনা করছে, এমনই কষ্ট অনুভব করছে সে। যা শিশুর প্রতি ভালবাসা, করুণার বিকিরণও রুদ্ধ করে, সেই ‘ব্ল্যাক হোল’ হল বর্ণবিদ্বেষ, তথা গাত্রবর্ণ-বিদ্বেষ।

Advertisement
আরও পড়ুন