একদা বাঙালি প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূল করিয়া তুলিতে পারিত। ঊনবিংশ শতক ইহার সাক্ষ্য বহন করিতেছে। সাহেবরা যখন ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় নব নব বিধান নির্মাণ করিলেন, সেই বিধানের মধ্যে বাঙালি নানা সুযোগ-সুবিধার ফাঁক খুঁজিয়া লইয়াছিলেন। সেই সকল বিধির গ্রহণ-বর্জন-নবায়নের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপনায় বাঙালির জাতিগত আত্মপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হইয়াছিল। বাঙালি ইংরেজি ভাষা শিখিয়াছিল— কেবল কাজের ভাষা হিসাবে নহে, জ্ঞানের ভাষা হিসাবেও। পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে বাঙালি প্রবেশ করিয়াছিল। দেশ হইতে দেশান্তরে গমন করিয়া নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইয়াছিল। ইহার ফলে ঘরে-বাহিরে বাঙালির জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির চরিত্র কিছু বদল হইলেও বাঙালি নিজের সব কিছু ছাড়িল, তাহাও মোটেই নহে। বিদ্যাসাগরের অঙ্গবস্ত্র দেশি— মেজাজ ও কর্মদক্ষতা সাহেবি। বিবেকানন্দকে নিবেদিতা বিলেতে এক রকম দেখিয়াছিলেন, এই দেশে আসিয়া আর এক রকম দেখিলেন। যখন যেমন তখন তেমন, এই নমনীয়তা বিবেকানন্দের ছিল। এই নমনীয়তাই বাঙালিকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা দিয়াছিল। এই নমনীয়তা উদ্যমশীলের বৈশিষ্ট্য। বিবেকানন্দ ইহাকে রজোগুণ বলিতেন। উদ্যোগ ও কর্মোদ্যম এই গুণের লক্ষণ। তাহা ছাড়া আর একটি বিষয় মনে রাখিতে হইবে। এই উদ্যমশীল কর্মোদ্যমী বাঙালি স্থিরলক্ষ্যের অধিকারী ছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কী করণীয়, তাহা স্থির করিয়া তাঁহারা সেই লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর হইতেন।
কতিপয় বাঙালি উদ্যোগপতির কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়িবে, যাঁহাদের জন্য এক কালে কলিকাতা ছিল ব্যবসাবাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। সন্দেহ নাই, ব্রিটিশ রাজের বড় ভূমিকা ছিল তাহাতে: গঙ্গানদীর নাব্যতা, কলিকাতা বন্দরের কার্যকারিতার উপর তাহাদের ছিল অটল আস্থা। অপর দিকে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো মানুষ, যাঁহারা নিজ পরিশ্রম ও মেধায় উদ্যোগে সাফল্যের অধিকারী হইয়াছিলেন। এই কারণেই কলিকাতায় বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আনাগোনাও বাড়িয়াছিল। প্রতিকূলতা কী ভাবে শক্তির উৎস হইতে পারে, তাহার একটি দৃষ্টান্ত সম্ভবত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা ইতিহাসে যত স্মরণ করা হয়, অর্থনৈতিক দিকটি তত হয় না, অথচ সেই সময় সীমিত পুঁজি সম্বল করিয়া বহুসংখ্যক অর্থনৈতিক উদ্যোগ বাংলায় দেখা গিয়াছিল। বেঙ্গল কেমিক্যালস বা বেঙ্গল পটারিজ়-এর কথা অনেকেই মনে রাখিয়াছেন, তবে বন্দে মাতরম দিয়াশলাই কিংবা ডাকব্যাক ওয়াটারপ্রুফ কোম্পানির উদাহরণ বিস্মরণে ডুবিয়াছে। কে সি দাশ রসায়নবিদ্যায় পারদর্শী হইয়া, আমেরিকা ও জাপানে শিক্ষালাভ করিয়া দেশে আসিয়া ওয়াটারপ্রুফ সামগ্রীর ব্যবসা তৈরি করেন। ১৯১৬ সালে তাঁহারা কয়েক জন মিলিয়া ক্যালকাটা কেমিক্যাল কম্পানি নির্মাণ করেন। বহু দিন তাঁহাদের প্রসাধন ও স্বাস্থ্যচর্চা সামগ্রীর সহিত বাঙালি পরিচিত ছিল— সুরভিত ল্যাভেন্ডার ডিউ পাউডার এবং নিম-সিঞ্চিত মার্গো সাবান স্মরণীয়। পরবর্তী কালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলিয়াছিলেন, “কেন বাঙালি কেবল চাকরি-চাকরি করে? অন্যের চাকর হইবার মধ্যে কী এমন মহিমা রহিয়াছে? তাহার অপেক্ষা অনেক ভাল পৃথিবীতে নিজের মতো চলাফেরা করা, নিজের মতো কিছু করা, সে যতই ছোট হউক।”
চলমান অতিমারি ঋতুতে এই সব বাঙালির কথা কেন মনে পড়িতেছে কে জানে। পরিস্থিতি পাল্টাইয়াছে, বাংলার, ভারতের, বিশ্বদুনিয়ার। কিন্তু তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি পাল্টাইয়াছে বাঙালির মানসভুবন। বিংশ শতকের ঠিক কোন সন্ধিক্ষণটিকে এই পরিবর্তনের মাইলফলক হিসাবে দেখা যায়, তাহা বিতর্কের বিষয়, গবেষণারও বিষয়। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গ যে নিজের লক্ষ্যযাত্রা হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই সে আজ পিছাইয়া পড়িয়াছে। তাহার মধ্যে সর্বপ্রধান— উদ্যোগ ক্ষেত্র। আজ বাঙালি উদ্যোগপতির সংখ্যা হাতে গোনা যায়, এবং সফল উদ্যোগপতির সংখ্যা প্রায় এক-দেড় আঙুলেই গোনা যায়। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মুখে কয়েক বার এই আক্ষেপ ধ্বনিত হইয়াছে। তবে ইহা কেবল আক্ষেপের বিষয় নহে। কী করিব আর কী করিব না, সে বিষয়ে সুস্থির পূর্ব-পরিকল্পনা জরুরি। লক্ষ্যভেদী অর্জুন যেমন ‘পাখির চোখ’ ছাড়া আর কিছু দেখিতেন না, সেই অর্জুন-অভ্যাস ফিরানো দরকার। বাঙালির বিচারবোধ, বিবেচনা ও স্বাধীন চিন্তাশক্তি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তাহা কি আবার জাগিয়া উঠিতে পারে না?