Narendra Modi

কাহার অসম্মান

এত দিনে ইহা গ্রীষ্মদাবদাহের মতো প্রখর যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেকে বিশেষ তেজের অধিকারী হিসাবে দেখাইতে ভালবাসেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৫৫

মেঘালয়ের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক হাটে হাঁড়ি ভাঙিয়াছেন। হাঁড়িটিতে যাহা ছিল, তাহা এমন কিছু গোপন বস্তু নহে। সকলেই অল্পবিস্তর সেই বিষয়ে অবগত। তবু সর্বসমক্ষে হাঁড়ি ভাঙিয়া ভিতরের কাসুন্দি বাহির করিলে একটু মুশকিল হয় বইকি, তাহাও আবার ঘরের লোকের দ্বারা। সুতরাং ‘ঘরে’ সাড়া পড়িয়াছে, ক্রোধ ক্ষোভ ভর্ৎসনা ইত্যাদি শুরু হইয়াছে। ঘরের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাবান দুই জনের নামই যে হেতু জড়াইয়াছে, বিষয়টি হয়তো আরও কিছু দূর গড়াইবে, এবং সত্যপাল মালিক মহাশয় কিছু সমস্যা ভোগ করিবেন। ইত্যবসরে বিষয়টি দিগ্বিদিকে মুখরোচক হইয়া উঠিয়াছে। স্বাভাবিক। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি প্রধানমন্ত্রী বিষয়ে অসম্মানসূচক কথা বলেন, এমনটি হইবারই কথা। তাহার উপর আবার যদি এমন কোনও ইশারা মিলে যে, দৃশ্যত দুই অতিনিকট সহকর্মী এবং সহমর্মী প্রকৃত ভাবে তত নিকট নহেন। রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক কৃষক আন্দোলন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহিত কথা বলিতে গেলে তিনি স্পর্ধিত বক্তব্য পেশ করিয়াছেন, এমন কথা শুনিয়াই নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওই জল্পনা-উদ্দীপক বাক্যগুলি উচ্চারণ করিয়াছেন।

জল্পনা-কল্পনার বাহিরেও অবশ্য কিছু কথা রহিয়া যায়। এত দিনে ইহা গ্রীষ্মদাবদাহের মতো প্রখর যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেকে বিশেষ তেজের অধিকারী হিসাবে দেখাইতে ভালবাসেন। ক্ষমতাসীন হইবার পর পরই যে তিনি নিজের ছাতি-মাপের কথা বলিয়াছিলেন, তাহা এই উদ্দেশ্যেই। তখনই বুঝা গিয়াছিল, পেশিশক্তি ও মানস-শক্তির মধ্যে যে বিরাট তফাত আছে, তাহা তিনি খেয়াল রাখিতে চাহেন না, অথবা পারেন না। গণতান্ত্রিক দেশের সর্বোচ্চ নেতা হইবার জন্য কাহারও ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি দেখাইবার প্রয়োজন তো পড়েই না, এমনকি যখন নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রমাণ করিবার প্রয়োজন পড়ে, তখনও দৃঢ়তাকে ঠিক শারীরশক্তির সহিত তুলনা করিতে নাই, অন্যথা নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকেই খাটো করা হয়— এই সব যুগসঞ্চিত প্রজ্ঞায় তিনি বিশ্বাস করেন না। পরবর্তী কালে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিষয়টি স্পষ্টতর হইয়াছে। সংসদের ভিতরে বিরোধিতার সামনে পড়িয়াই হউক, আর সংসদের বাহিরে আন্দোলনের লক্ষ্য হইয়াই হউক, প্রধানমন্ত্রী মোদীকে প্রায় সর্বদাই এমন এক জেদ ও স্পর্ধার সহিত প্রতিপক্ষের সহিত যুঝিতে দেখা গিয়াছে, যাহা দেশের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবেশটিকে দূষিত ও ধ্বস্ত করিয়াছে। নোটবন্দি হইতে জিএসটি, শিক্ষা বিল হইতে কৃষি বিল, সবই তিনি ও তাঁহার সরকার কার্যত সংসদে বিনা আলোচনায় পাশ করিয়াছেন। কৃষি বিলের ক্ষেত্রে, এক বার তাহা পাশ হইবার পর দীর্ঘ কৃষক আন্দোলনের সামনে সরকার বোঝাপড়ার ইচ্ছা পর্যন্ত প্রকাশ করে নাই— তাহাতে নাকি প্রধানমন্ত্রীর অসম্মান হইতে পারিত।

Advertisement

বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই স্পর্ধিত সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। বিরোধীদের সহিত দুর্ব্যবহারে ও দুর্বাক্যে তাঁহার খ্যাতি-প্রতিপত্তি একই মাত্রার, কিংবা আরও বেশি। তাহা সত্ত্বেও যে ঘটনাচক্রে এই বক্রোক্তিটি লোকসমক্ষে প্রকাশিত হইয়া পড়িল, ইহা কৌতূহলোদ্দীপক বটে। ইতিহাস প্রমাণ— স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্ব শেষ অবধি দীর্ঘমেয়াদে সাফল্যের মুখ দেখিতে পারে না। প্রতিরোধ যখন আসে, তখন খুব নিকট জনের কাছ হইতেই আসে। এই জন্যেই সকলকে লইয়া চলিবার একটি নীতি গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া গৃহীত হয়। নরেন্দ্র মোদী তাঁহার জনপ্রিয়তা বারংবার ভোটবাক্সে প্রমাণ করিয়াছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনমঞ্চে তাঁহার দক্ষতা আজিও প্রমা‌ণ হয় নাই। নির্বাচিত হইয়া আসিবার প্রথম দিনেই সংসদের সোপানে মাথা ঠেকাইয়াছিলেন ঠিকই, কিন্তু সংসদীয় তন্ত্রকে নরেন্দ্র মোদী গত সাত বৎসরেও সম্মানিত করিতে পারেন নাই।

আরও পড়ুন
Advertisement