চিত্রতারকার বিরুদ্ধে মামলা, তাও আবার তাঁরই ভক্তের মৃত্যুর ঘটনায়, শুনলে সিনেমার মতো মনে হতে পারে। গত সপ্তাহে হায়দরাবাদে তা-ই ঘটল, তারকা-অভিনেতা অল্লু অর্জুন ও তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দলের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ দায়ের করেছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার দু’টি ধারায়। সদ্য মুক্তি পাওয়া একটি ছবি শুরুর আগে তারকা হাজির হয়েছিলেন প্রেক্ষাগৃহে, সিনেমাহল কর্তৃপক্ষকে প্রায় শেষ লগ্নে জানিয়ে। প্রিয় নায়ককে এক ঝলক দেখতে প্রায় এক লক্ষ মানুষ হুড়োহুড়ি করতে থাকলে তারকার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তৈরি হয় পদপিষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতি। তারই জেরে দমবন্ধ হয়ে মারা যান এক মহিলা দর্শক। তাঁর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতেই পরে পুলিশ অভিনেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন ওঠানো জরুরি। দর্শকদের হুড়োহুড়ির দায় কি আদৌ তারকার হতে পারে? প্রশ্নটি একমাত্রিক বা সরল নয়। এক দিক দিয়ে নিশ্চয়ই জনপ্রিয় তারকাকে এমন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা অসঙ্গত, এমনকি অন্যায়। তিনি তাঁর কাজ করছিলেন, দর্শকরা কী করছিলেন, তার দায় প্রত্যক্ষত তাঁর হতে পারে না। তবে পরোক্ষত কিছু দায়িত্ব তাঁর থাকার কথা। তাঁর মনে রাখার কথা যে, ভারতে ব্যক্তিপূজার প্রভাব এমনই যে, সচরাচর যে কোনও ক্ষেত্রের তারকাই মাত্রাতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ও গৌরব উপভোগ করেন। চিত্রতারকার ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। তারকারাও অনেক সময় এর সুযোগ নেন, বাস্তবেও আচরণ করেন পর্দার মতোই: অতিনাটকীয় ভাবে। তা না হলে অভিযুক্ত অভিনেতা কখনও আগে থেকে না জানিয়ে প্রেক্ষাগৃহে আসতেন না। ভক্তেরা তাঁকে দেখতে কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে তা তাঁর বিলক্ষণ জানা, এবং ঠিক সেই কারণেই তাঁর হওয়া প্রয়োজন অত্যন্ত সংযত ও নিয়ন্ত্রিত— লক্ষ দর্শককে চমক দিতে হঠাৎ হাজির হয়ে যাওয়ার মতো প্রগল্ভতা তাঁর সাজে না। সিনেমাহলে তারকার উপস্থিতি নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু তা সর্বদাই হওয়া দরকার পূর্বঘোষিত ও পরিকল্পিত, যাতে তারকার নিরাপত্তা এবং দর্শকেরও সুরক্ষায় কোনও বিঘ্ন না ঘটে। এই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার দায়িত্বটি সিনেমাহল কর্তৃপক্ষের। সুতরাং হায়দরাবাদে খোদ তারকার কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের জন্যই পরিস্থিতি সামলানো যায়নি। ঘটনার পরোক্ষ দায় কি তারকার নয়?
পূর্ব-উদাহরণ বলছে, ভারতীয় সমাজ তারকার কাছে এই দায়বদ্ধতা প্রত্যাশা করে না। সেই কারণেই দর্শকের মৃত্যুকে বলা হয় শুধুই এক দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা। তবু তাঁর বিষয়ে অভিযোগটুকু পুলিশের খাতায় উঠল, অন্য দিকে কাঠগড়ায় তোলা গেল না বোধবুদ্ধিবিবর্জিত দর্শকের আচরণকে। ভারতীয় দর্শকদের আর একটু বোধ ও দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। তারকার তারিফ এক কথা, আর তাঁর দিকে লাখো মানুষের প্রবলবেগে ধেয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। একই ঘটনা ঘটে অন্যত্রও: দেবদর্শন কিংবা ধর্মগুরুর পাদস্পর্শের অস্থিরতায় নিমেষে ঘটে যায় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। ধর্মাচরণ বা বিনোদন, দুই রকম ব্যাকুলতার প্রকাশ। কিন্তু প্রশ্নটি যেখানে লক্ষ মানুষের উপস্থিতির, সেখানে সমষ্টির বোধবুদ্ধির ব্যবহার জরুরি। আর সমষ্টি আত্মনিয়ন্ত্রণ না দেখাতে পারলে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে, গত্যন্তর নেই।