বিক্ষোভ: সংবাদকর্মীদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে আগরতলায় তৃণমূল কংগ্রেসের মিছিল। ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১। পিটিআই।
২০১৮-র ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে ৪৩.৫৯ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল বিজেপি— একেবারে শূন্য থেকে ছত্রিশ আসনে বিজয়ী! আরএসএস নেতা সুনীল দেওধরের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা আর হিমন্তবিশ্ব শর্মার ভোট-কুশলী প্যাঁচ পয়জারের ফল ছিল পঁচিশ বছরের বাম শাসনের অবসান। তখন গোটা দেশে বিজেপির বিজয়কেতন উড়ছে। একুশটি রাজ্যে বিজেপি একা বা অন্য দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায়। ১৯৯৩-এর পরবর্তী সিকি শতকে কোনও রাজনৈতিক দল রাজ্যে-রাজ্যে এমন ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। সেই অবস্থাতেও ত্রিপুরার মতো ছোট একটা রাজ্যে এমন জয় তাৎপর্যপূর্ণ কেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ব্যাখ্যা করেছিলেন। সে বারই প্রথম বিজেপি সরাসরি লড়াই করে বামেদের সপাটে হারিয়ে দিল। এই জয় ছিল মতাদর্শের জয়। মোদীর ভাষায় এই জয় তাই ‘ঐতিহাসিক’।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর হারের কারণ অনুসন্ধানে, এবং বিপর্যয় মোকাবিলার পদ্ধতি নির্ধারণে এক বৈঠকে বসে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি। প্রত্যেকেই নানা ধরনের ভুলভ্রান্তির কথা তুলে ধরেন। কঠোর আত্মবিশ্লেষণের পরামর্শ আসে সর্বাধিক সংখ্যায়। সবার কথাই মন দিয়ে শোনেন রাহুল গান্ধী। এবং এর পরই নাকি তাঁর প্রশ্ন ছিল, ‘হাউ টু ডিপোলারাইজ় ইন্ডিয়া’? এই সর্বনাশা মেরুকরণ থেকে বেরনোর রাস্তা কী? কারও কাছেই এই প্রশ্নের জবাব ছিল না।
অথচ, এই জবাব ছাড়া বিজেপিকে হারানো সম্ভবও নয়। ফলে ক্রমশ অবান্তর হচ্ছে স্থানীয় বা আঞ্চলিক বিষয়। জাতীয় ঝোঁক যে দিকে, সে দিকেই হেলে যাচ্ছে জনমত। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফসল ঘরে তুলছে বিজেপি। এই বিষয়েই চমৎকার গবেষণা রয়েছে রোহিত কুমারের। ‘দ্য বিজেপি’জ় ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি অবস্কিয়োরস দ্য লোকাল ইন ফেভার অব দ্য ন্যাশনাল’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন, কী ভাবে তীব্র আগ্রাসী জাতীয় হিন্দুত্বের কাছে ক্রমশ হেরে যাচ্ছে স্থানীয় বিষয়, আঞ্চলিক নেতৃত্ব এবং রাজ্য রাজনীতি। প্রতিটি নির্বাচনই এখন এই দেশে তাই ভাবনা ও আদর্শের সংঘাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজেপির রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রতিস্পর্ধী মতাদর্শ অবশ্যই উদার, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। কিন্তু অবয়বহীন এই আদর্শকে যাতে সাধারণ মানুষ আপন করে নিতে পারেন, তেমন কোনও রূপ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলেই কংগ্রেস রাজনীতির সর্বস্তরে বিজেপির কাছে হারছে।
অর্থাৎ, আর্যাবর্তের হিন্দুত্বের এক পরিপন্থী চেহারার প্রয়োজন বিজেপিকে হারাতে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক সেই প্রতিরোধী ভাবনাটাকেই সফল ভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিল তৃণমূল। ‘হিন্দুত্ব বনাম বাঙালিয়ানা’র সেই লড়াইয়ে টিকতে পারেনি গো-বলয়ের সংস্কৃতি। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল স্বাভাবিক ভাবেই মমতা তথা তৃণমূলকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। ২০১১-য় বামফ্রন্টকে হারানো এবং একুশে মোদী-মমতা দ্বৈরথে মমতার জয়ে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাংলার মাটি সত্যিই তৃণমূলের দুর্জয় ঘাঁটি। নেতৃত্বের সঙ্কটে দীর্ণ কংগ্রেস যতই ভাঙা হাটের চেহারা নিচ্ছে, ক্রমপ্রসারিত বিরোধী পরিসরে তৃণমূলের পদচারণার সুযোগ ততই বাড়ছে।
‘পশ্চিমবঙ্গের একটি আঞ্চলিক দল’, এই সঙ্কীর্ণ পরিচিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, ‘সর্বভারতীয় দল’-এর মর্যাদা পেতে হলে তৃণমূলকে বাংলার বাইরে পা ফেলতেই হবে। আদ্যন্ত বাঙালি এই দলটির পক্ষে রাতারাতি ‘সর্বভারতীয়’ তকমা অর্জন করা সুকঠিন। এমন পরিস্থিতিতে ত্রিপুরা তৃণমূলের কাছে নানা যুক্তিতেই স্বাভাবিক গন্তব্য মনে হয়। রাজ্যটি বাঙালি-প্রধান। ২০১১-র জনশুমারির হিসাবে ত্রিপুরাতে প্রায় ৬৪ শতাংশ মানুষই বাংলাভাষী। দ্বিতীয়ত, আরএসএস বেশ ক’বছর ধরে সক্রিয় থাকলেও রাজ্য বিজেপিতে অন্য দল থেকে আসা অভিবাসী রাজনীতিকদের ভিড়ই বেশি। তলার দিকের কর্মী সমর্থকদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। অর্থাৎ, বিজেপি এখনও রাজ্যবাসীর মনোভূমির গভীরে থিতু হতে পারেনি। তৃতীয় কারণটি সর্বজনবিদিত— মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে রয়েছে দলীয় কোন্দল। মন্ত্রিসভার শেষ দফা রদবদল করে পরিস্থিতি সাময়িক সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু কান পাতলেই অন্দরের অসন্তোষের ফিসফিসানি শোনা যায়। চতুর্থ কারণটি হচ্ছে প্রতিশ্রুতি পূরণে রাজ্য স্তরে দল ও সরকারের ব্যর্থতা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে রাজ্যে-রাজ্যে বিজেপির রিপোর্টকার্ড যথেষ্ট সন্তোষজনক। ত্রিপুরাই এই ক্ষেত্রে সম্ভবত দলের জন্য অস্বস্তিকর ব্যতিক্রম।
ত্রিপুরা দখলের পরিকল্পনার বাস্তবায়নেই চার প্রজন্মের কংগ্রেসি পরিবারের সুস্মিতা দেবকে তৃণমূলে নিয়ে আসা হল। দেশের পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে কংগ্রেস ত্যাগ করলেন সুস্মিতা। পর দিনই ডেরেকের হাত ধরে তৃণমূলে যোগদান। এক মাসের মধ্যেই রাজ্যসভার সাংসদ পদে তৃণমূলের মনোনয়ন। এত দ্রুতলয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে রাজনৈতিক বার্তাটি উঠে আসে তা হল, সুস্মিতার লড়াকু চরিত্র, সর্বভারতীয় পরিচিতি, পারিবারিক অতীত, তাঁর বাবা প্রয়াত সন্তোষমোহন দেবের সফল ত্রিপুরা-সংশ্রবকে কাজে লাগিয়ে ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনের রণভূমিটি প্রস্তুত করা। বরাক উপত্যকার সঙ্গে ত্রিপুরার ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক নৈকট্যও এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। ব্রাত্য বসু, কুণাল ঘোষ কিংবা সায়নী ঘোষকে অনায়াসে ত্রিপুরাতে ‘বহিরাগত’ বলে দেগে দেওয়া গেলেও সুস্মিতার বেলায় তা ততটা সহজ হবে না— কথাটা তৃণমূল বিলক্ষণ মাথায় রেখেছে।
এ সবই তৃণমূলের পক্ষে যাচ্ছে, তা ঠিক। মাত্র তিন মাসের উপস্থিতিতে ‘মামলা ও হামলা’ সামলে ত্রিপুরার পুর নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে আগরতলায় সিপিএমকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে চলে যাওয়া, এবং গোটা রাজ্যে তৃতীয় হলেও ষোলো শতাংশের বেশি ভোট হাসিল করাও চাট্টিখানি কথা নয়। তবে, আগরতলা পুর নিগম-সহ তেরোটি পুরসভা ও ছয়টি নগর পঞ্চায়েতের নির্বাচনে তৃণমূল বিজেপির ভোটে ভাগ বসাতে পারেনি। প্রস্তুতিপর্বে তৃণমূল প্রত্যাশিত ভাবেই বৃহত্তম বিরোধী শক্তি হওয়ার জন্যই ঝাঁপিয়েছে। এবং তাতে অনেকাংশেই সফল হয়েছে। কিন্তু আগামী চোদ্দো মাসের মধ্যে শাসকের আসনে বসতে গেলে দলকে বিজেপির সমর্থনভূমিতে তাঁবু খাটাতে হবে। রাজ্যের মানুষ দল হিসাবে বিজেপির প্রতি অসন্তুষ্ট, এমন কথা বলার মতো কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। অসন্তোষ যা রয়েছে, তা মূলত সরকারের কাজকর্ম নিয়ে। আরও স্পষ্ট করে বললে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে। এই বিচ্ছিন্ন অসন্তোষকে জনরোষে বদলে দেওয়া কঠিন। অন্তত এই মুহূর্তে। অবস্থা বেগতিক দেখলে বিজেপি রাজনাথ-ঘনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী পাল্টে দেবে। তাতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নেওয়া যাবে।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করা জরুরি। বিভাজনের হিংসায় দেশান্তরি হয়ে এ রাজ্যে যাঁরা পাকাপাকি আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের, বা উত্তরপ্রজন্মের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী চেতনার সঞ্চার সহজ নয়। উদার প্রগতিশীল ও সহনশীল বাঙালিয়ানা দিয়েই বিজেপিকে রোখার চেষ্টা করবে তৃণমূল। কিন্তু সেখানেই সক্রিয় হবে পার্টিশন রেফারেন্স। ‘বিভাজনের হিংস্র স্মৃতি’ তাড়া করবে ভোটারদের। মেরুকরণ ঠেকানো যায় কী করে, রাহুলের এই প্রশ্নের জবাব ত্রিপুরাতে খুঁজবেন মমতা।
এর সঙ্গেই উঠে আসবে জনজাতি সংগঠন তিপ্রা মথার পৃথক তিপ্রা ল্যান্ড দাবিতে তৃণমূলের অবস্থানের প্রশ্নটিও। রাজ্যের ষাটটির মধ্যে কুড়িটি আসন জনজাতি নিয়ন্ত্রিত। আগরতলা দখলে রাজপরিবারের বর্তমান যুবরাজের সঙ্গে তৃণমূল কী শর্তে রফায় যেতে পারে, তা এই মুহূর্তে কোটি টাকার প্রশ্ন। অবশেষে অবশ্যই রয়েছে সিএএ প্রসঙ্গে তৃণমূলের বিরোধিতা। হিন্দু বাঙালি অধ্যুষিত ত্রিপুরায় উদ্বাস্তু হিন্দুর নাগরিকত্বের বিরোধিতা ভোটের ময়দানে ক্ষতিকারক হতে পারে।
এই জটিল জনবিন্যাস ও স্বার্থের সংঘাতের সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান করা যাবে কি না, সেই প্রশ্নটি জরুরি। জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূলের ভবিষ্যৎ স্থির করে দেবে তেইশের ত্রিপুরাই।
অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ, শিলচর