‘শ্মশানের ইতিহাস’ (১০-১২) সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা। সম্পাদকীয়তে বাংলার এক সময়ে শিল্পবিকাশের প্রথম সারিতে থাকা এবং সেখান থেকে তার পতনের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে শিল্পক্ষেত্রে বাংলার যে উচ্চ স্থান ছিল তা বাধাপ্রাপ্ত হয় কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের ফলে। কেন্দ্রের মাসুল সমীকরণ নীতি এবং পাটশিল্পের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না করা, বাংলার শিল্প সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিতে সাহায্য করেছিল। যদিও কেন্দ্রের সাহায্য ও বিধান রায়ের প্রচেষ্টা ও দূরদৃষ্টিতে ভর করে দুর্গাপুরে বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে ওঠে এবং একটি আধুনিক শহর হিসাবে দুর্গাপুর শহরের পত্তন ঘটে। একই ভাবে কল্যাণীতেও বিধান রায়ের উদ্যোগে ডেয়ারি শিল্প গড়ে ওঠার মাধ্যমে কল্যাণী একটি পরিকল্পিত আধুনিক শহর হিসাবে গড়ে ওঠে।
পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের লাইসেন্স পারমিটের সুবিধে পেয়ে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্নাটক বাংলাকে পিছনে ফেলে দেয়। বাংলার শিল্পে বিনিয়োগ ও নিয়োগ হ্রাস পায় যার পরিণতিতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। কিন্তু কী ভাবে বাংলাকে আবার দেশের শিল্প মানচিত্রে ভাল জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, তার কোনও দিশা তাদের কাছে ছিল না। কারণ ক্ষমতায় আসার পর তারা যে সব বিষয়ে জোর দিয়েছিল সেগুলো হল, ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ইত্যাদি। অর্থাৎ, গ্রামে ভিত পাকাপোক্ত করাই ছিল বামেদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এ ছাড়া এই সময়ে তারা বেসরকারি পুঁজির তীব্র বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। বামপন্থী দলগুলোর বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে টাটা বিড়লা-র ‘কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ স্লোগান খুবই জনপ্রিয় হয়। এরই জেরে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠে বাংলার বিভিন্ন কলকারখানায় এবং ধীরে ধীরে বাংলা থেকে পুঁজির নিষ্ক্রমণ ঘটে। দেশের শিল্প মানচিত্রের নীচের দিকে বাংলার স্থান হয়। ১৯৯০-এর দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিরোধিতা করে বামপন্থীরা বাংলায় শিল্প সম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত করে। পরবর্তী কালে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার মতো তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য টাটার হাত ধরে সিঙ্গুরে শিল্প স্থাপন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সরকারের জোর-জবরদস্তির ফলে কৃষকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয় যা গণ বিদ্রোহের আকার ধারণ করে এবং সিঙ্গুরে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ মাঠে মারা যায়।
বর্তমান শাসক দল জোর করে জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প স্থাপনের বিরোধী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উন্নত করাই বর্তমান সরকারের শিল্পোদ্যোগের মূল ভিত্তি। যদিও প্রতি বছর তারা দেশি-বিদেশি উদ্যোগপতিদের এনে শিল্প স্থাপনের প্রচেষ্টাকে জারি রেখেছে। এখন আর ইংরেজরা নেই, তাই আমরা ইতিহাসকে দোষ দিতে পারব না। কিন্তু সঙ্কীর্ণ রাজনীতি আছে। সম্পাদকীয়তে যথার্থ ভাবেই তা উল্লিখিত হয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে বাংলার হৃত গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে হলে যা প্রয়োজন তা হল— দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে শিল্প স্থাপনের জন্য বর্তমানে যে সুযোগগুলো রয়েছে সেগুলিকে কাজে লাগানো।
নারায়ণ দত্ত, বর্ধমান
শিল্পের পরিবেশ
‘শ্মশানের ইতিহাস’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, বঙ্গ বিজেপির এক সাংসদের প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় কর্পোরেট বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, গত পাঁচ বছরে ২২২৭টি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের দফতর সরিয়ে নিয়েছে। এদের মধ্যে ৩৯টি সংস্থা শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত ছিল। প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের ভিত্তিতে বিজেপির ওই সাংসদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের পরিবেশ নেই। কিন্তু এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দাবি যে অন্য কথা বলছে।
রাজ্যের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ এখন দেশের ‘নতুন আইটি রাজধানী’ হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। দেশের প্রথম সারির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি-সহ আরও অনেক সংস্থা বাংলায় কাজ করে। রাজারহাট-নিউ টাউনে ২০০ একর জুড়ে বাংলার সিলিকন ভ্যালি টেক হাবে প্রায় ২.৬ লক্ষ লোক কাজ করেন। ন’টি বড় সিমেন্ট সংস্থার প্রায় সবই রয়েছে বাংলায়। এ ছাড়া, বাংলার তাঁত শিল্পেরও খ্যাতি দেশজোড়া। বেঙ্গল গ্লোবাল বিজ়নেস সামিট, ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট চামড়া রফতানির ১২ শতাংশ চামড়া এবং লোহা ও ইস্পাত রফতানির ১০ শতাংশ হয় এ রাজ্য থেকে। মাঝারি, ছোট ও ক্ষুদ্র (এমএসএমই) শিল্পের ক্ষেত্রে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দ্বিতীয়। প্রায় ৯০ লক্ষ এমএসএমই রয়েছে এখানে, যা ভারতের মোট এমএসএমই-র ১৪ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পগুলির মধ্যে, পুরুলিয়ায় ৪০০০ একরের উপরে জঙ্গল সুন্দরী কর্মনগরী শিল্প টাউনশিপ স্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খোলা মুখ কয়লা খনি ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিংহে শীঘ্রই কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রায় ১০০০০ একর এলাকা জুড়ে ২০০-রও বেশি শিল্প পার্ক বা এস্টেট-সহ শিল্প-পরিকাঠামো বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রাজারহাটে একটি ২০০ একর আইটি এবং ইলেকট্রনিক্স পার্ক (সিলিকন ভ্যালি) স্থাপন করা হয়েছে। বাংলায় শিল্পায়নের গতি বাড়াতে তিনটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ করিডর গড়ে তোলা হচ্ছে: ডানকুনি-রঘুনাথপুর, ডানকুনি-কল্যাণী, ডানকুনি-হলদিয়া। রাজ্যের কলকাতা এবং হলদিয়ায় দু’টি বড় কন্টেনার এবং বাল্ক হ্যান্ডলিং বন্দর রয়েছে।
রাজ্যে শিল্পের পরিবেশ নেই বলতে গেলে ধরে নিতে হবে যে, রাজ্য সরকারের সমস্ত দাবি মিথ্যে। সত্যিই কি তা-ই? হয়তো নানাবিধ কারণে কিছু সংস্থা এ রাজ্য থেকে চলে গেছে, তবে নতুন বিনিয়োগ এনে নতুন শিল্প স্থাপনে রাজ্য সরকার যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা অনস্বীকার্য। বিজেপি সাংসদের উক্তিটি নেহাতই হতাশাব্যঞ্জক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চালিত।
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
উন্নতিতে বাধা
সংসদে আলোচিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এক তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, গত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২২২৭টি বেসরকারি সংস্থা তথা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর বিদায় নিয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি সংস্থা শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত ছিল। বর্তমান যুগ কর্পোরেট বাণিজ্যের যুগ। পাঁচ বছরে এতগুলো সংস্থার বিদায় সত্যিই রাজ্যের অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকর। আলোচনায় জানা গেল এই শ্মশানের নিস্তব্ধতা গত বামফ্রন্ট জমানা থেকে শুরু হয়েছিল। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস বা অ-বিজেপি সরকার। তখন আমরা প্রায়ই শুনতাম কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বিরোধ বা বঞ্চনার কথা। এখন ঠিক সে রকম ভাবে শোনা না গেলেও অন্য রকম ভাষায়, অন্য রকম ভাবে তা এখনও চলে আসছে।
এ দিকে, ‘নামের গেরো’ শীর্ষক পরবর্তী সম্পাদকীয়তেও সে বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর নামোল্লেখকে কেন্দ্র করে বিরোধী কয়েকটি রাজ্যে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ দেখা যাচ্ছে। উক্ত প্রবন্ধে বলা হয়েছে, রাজ্যের শিক্ষা খাতে প্রায় ১,৮০০ কোটি টাকা কেন্দ্র আটকে রেখেছে। এতে বঞ্চনার অভিযোগ জোর পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সরকার শাসন ক্ষমতায় না থাকলেও বিজেপির বহু সমর্থক বা একটা অংশ কি এর ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন না? যেখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ জড়িত তা রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা উচিত নয়। সেই বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকার তথা রাজ্যের বিরোধী সরকারকেও মনে রাখতে হবে। প্রবন্ধে যথার্থ উল্লেখ করা হয়েছে, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (ইউবিআই) এবং এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের দফতর পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরানো হয়েছে। সেটা কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারেরই নির্দেশে। তখন রাজ্যের বিরোধী দল সেই বিষয়ে প্রতিবাদ করেনি। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে না উঠলে রাজ্যের উন্নতি সম্ভব নয়।
বাঁধন চক্রবর্তী, আগরতলা, ত্রিপুরা