Hindi Language

সম্পাদক সমীপেষু: রাজভাষা হিন্দি?

পত্রলেখক আরও বলেছেন, কোনও অবাঙালি কর্মীর বাংলা না জানার জন্য সরকারি কাজে বিঘ্নের কথা তিনি দেখেননি বা শোনেননি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৩৬

‘অগণতান্ত্রিক’ (সম্পাদক সমীপেষু, ২৭-১২) চিঠিতে পত্রলেখক মিহির কানুনগো “বঙ্গে চাকুরি করিতে হইলে বাংলা ভাষাটি শিখিয়া লইতে হইবে” এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, “ভারতে হিন্দি রাজভাষা হিসাবে সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃত।” এই তথ্য উনি কোথায় পেলেন? ভারতে কোনও রাজভাষা নেই, ‘সরকারি ভাষা আইন’ অনুসারে ২২টি ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলভুক্ত এবং হিন্দি ও বাংলা উভয়ই সেই ভাষাগুলির অন্যতম। সাংবিধানিক ভাবে ২২টি ভাষাই সমান মর্যাদা পায়‌, হিন্দির আলাদা কোনও মর্যাদা নেই।

পত্রলেখক আরও বলেছেন, কোনও অবাঙালি কর্মীর বাংলা না জানার জন্য সরকারি কাজে বিঘ্নের কথা তিনি দেখেননি বা শোনেননি। তিনি না শুনতে পারেন, কিন্তু হিন্দিতে তেমন সড়গড় না হওয়ায় আমার পরিচিত বহু মানুষকেই ব্যাঙ্ক বা সরকারি দফতরে সমস্যায় পড়তে দেখেছি। কিছু মাস আগেই এক বাঙালি পরিচালক সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে, এক অনলাইন ডেলিভারি সংস্থার অবাঙালি কর্মী তাঁকে হিন্দি না জানায় অপমান করে বলেছেন, ভারতে থাকতে হলে হিন্দি জানতেই হবে, নচেৎ বাংলাদেশে চলে যেতে হবে। আমি নিজেই কিছু দিন আগে ইউটিউবে এক ভিডিয়োতে বাংলায় মন্তব্য করায় এক অবাঙালির কাছে ঠিক একই কথা শুনেছি। ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের’ একাধিপত্যকামী প্রচারের চোটে বাংলাকে কেবল বাংলাদেশের ভাষা হিসাবে দেখার এক মারাত্মক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।

Advertisement

পত্রলেখক বাংলায় চাকরি করার জন্য বাংলা শেখার সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক বলেছেন। কিন্তু তিনি এটা ভাবলেন না, এক জন হিন্দিভাষী যখন বাংলায় আসেন, বাংলার মানুষ তাঁর সমস্যার কথা ভেবে হিন্দিতেই কথা বলেন, অন্তত চেষ্টা করেন। কিন্তু এক জন বাঙালি ভিনরাজ্যে গেলে সেটা দেখা যায় না। হিন্দি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বলে সংখ্যালঘু বাঙালিকে সেটা শিখতেই হবে, আর সংখ্যালঘুর ভাষা বলে হিন্দিভাষীরা বাংলা শিখবেন না, এটা গণতান্ত্রিক?

জিতাংশু নাথ, কলকাতা-৫৯

বিলেতে বাংলা

“‘বিনে স্বদেশী ভাষা’” (১৯-১২) সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় প্রধান ভাষা বাংলা। যে খবরের উপর নির্ভর করা হয়েছে, সেটি সত্য নয়। ইংল্যান্ডের সরকারি দফতর ‘অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্স’-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২০১১-র জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইংরেজির পর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা পোলিশ, তার পর পঞ্জাবি। ২০২১-এর জনশুমারির তথ্য প্রকাশ বাকি আছে। নির্দিষ্ট ভাবে বাংলা ভাষাকে কোথাও দ্বিতীয় প্রধান ভাষার সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিতও করা হয়নি। ভুয়ো খবরটির উৎস সম্ভবত লন্ডনের ‘সিটি লিট’ নামে একটি বেসরকারি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে, ৭১,৬০৯ জন ব্যবহারকারী থাকায় বাংলা লন্ডনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত কথ্য ভাষা। সমীক্ষার দাবিটিও প্রশ্নাতীত নয়। কারণ উল্লিখিত জনশুমারি অনুযায়ী, লন্ডনে বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী বাসিন্দার সংখ্যা ২,২১,০০০।

অতীন বাগচি, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

উপেক্ষিত

“‘বিনে স্বদেশী ভাষা’” সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, “রামমোহন রায় বঙ্গভাষার গদ্য রচনা করিয়া সমাজ-সংস্কার করিলেন, আবার তিনি ফরাসি দেশের রাজনীতির খবরে কান পাতিয়া রাখিলেন। সেই দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হইলে তাঁহার আনন্দের সীমা রহিল না। এই ধারারই উত্তরসূরি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ— স্বদেশি ভাষার প্রতি প্রীতি ও আন্তর্জাতিকতার প্রতি আগ্রহ দুইয়ের সমবায়ে তাঁহারা বঙ্গ-সংস্কৃতির নবনির্মাণ ঘটাইলেন।”

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজে সংস্কারের উপযোগী পরিবেশ গড়ার তাগিদে এক দিকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন, অপর দিকে সরল বাংলা গদ্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। এই ধারাতেই এলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলা গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের ঐতিহাসিক অবদানকে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।... বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছশৃংখল জনতাকে বিদ্যাসাগর সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাতে সহজ গতি এবং কার্য কুশলতা দান করিয়াছেন।” বিদ্যাসাগরের লেখা বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে জীবনচরিত (কোপারনিকাস, গালিলেও, নিউটনের মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনী), বোধোদয় (সরল বাংলা ভাষায় আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ছাত্রদের প্রাথমিক ধারণা দেওয়া), কথামালা, আখ্যান মঞ্জরী (ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নীতিশিক্ষা) প্রভৃতি পুস্তক তৎকালীন বঙ্গসমাজে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা-সম্পন্ন যথার্থ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার পথনির্দেশ করেছে। রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত “অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্বের অধিকারী” এই মানুষটি, যিনি গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রসারের জন্য আমৃত্যু লড়াই করলেন, সেই মনীষীর নাম সম্পাদকীয়তে উপেক্ষিত থেকে গেল কী ভাবে?

দেবাশিস রায়, আন্দুলমৌরি, হাওড়া

চাই পরিভাষা

‘মাতৃভাষায় পড়ি, এই অহঙ্কার’ (১৮-১২) প্রবন্ধটি পড়ে অহঙ্কার হয়, আশঙ্কাও হয়। বাংলা ভাষা কি সত্যিই তার মর্যাদা পাচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গের বাজারে চোখ ঘোরালেই দেখা যাবে ইংরেজি ভাষার আধিক্য। ছোট-বড় দোকানের সাইনবোর্ডগুলিতে বাংলার পরিবর্তে বিদেশি ভাষা বেশি চোখে পড়ে। রাজ্য সরকারের সমস্ত বিজ্ঞপ্তি ইংরেজিতেই প্রকাশিত হয়। অনেক কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষাকে ব্যবহার করছে। নতুন প্রজন্মের বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা তো আছেই। বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও কতটা পরিষ্কার ভাবে বাংলায় কথা বলতে পারবে, প্রশ্ন থেকে যায়।

বাংলা ভাষা আমাদের গর্বের ভাষাও বটে। ও-পার বাংলায় ভাষা আন্দোলন আমরা সবাই জানি। ভারতে ১৯৬১ সালে ১৯ মে অসমের শিলচরে মাতৃভাষার জন্য গর্জে উঠেছিল সেখানকার বাংলাভাষী মানুষ। ১১ জন আন্দোলনকারীকে হত্যা করেছিল অসম পুলিশ। অথচ, এখন নামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাংলা ভাষাকে অনেকটা পিছনের সারিতেই রাখা হয়। কারণ, ভাল চাকরি পেতে গেলে ইংরেজি বলতে জানতেই হবে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার সংসদে বাংলা ভাষা স্থান পেয়েছে। বহির্বিশ্বে ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ। প্রতি বছর সেখানে অসংখ্য পড়ুয়া বাংলা ভাষায় শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছেন। আমাদের বাংলায় মাতৃভাষাকে ছোট করে দেখা মূর্খামিমাত্র।

এ কথা সত্য যে, ইংরেজি ভাষা ছাড়া আমাদের দফতরের কাজ অচল। শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব দিনে দিনে কমছে। অভিভাবকরা নিজের সন্তানকে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলির হাতে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত থাকছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় দখলকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই ঘোষণা ছাত্রছাত্রী ও সমাজের মনে কিছুটা হলেও মাতৃভাষার গুরুত্ব বিস্তার করতে পারবে বলে আশা করা যায়। বাংলায় পরিভাষার অভাব অনেকখানি। পরিভাষাকে নিয়ে কাজ কম রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি নজর দরকার বলে মনে করি।

শুভঙ্কর পাত্র, রানাঘাট, নদিয়া

আরও পড়ুন
Advertisement