‘মাধ্যমিক শেষে বই, জামা ছিঁড়ে উল্লাস’ (২৩-২) শীর্ষক সংবাদটি দৃষ্টি আকর্ষণ করল। পর্ষদ সভাপতি বই ছেঁড়াকে দুর্ভাগ্যজনক ও কাম্য নয় বলেছেন। এক প্রধান শিক্ষক অভিভাবকদের নজরদারির অভাবকে কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কোনও শিক্ষক পড়ুয়াদের বেশি মোবাইল আসক্তির কথা জানিয়েছেন। আবার কোনও শিক্ষক পাশফেল প্রথা না থাকাটাও কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এর সঙ্গে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বক্তব্যটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ছাত্রছাত্রীদের একাংশের বইখাতার সঙ্গে ভালবাসার যোগ এখন নেই।
মোক্ষম কথা। কিন্তু বইয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ভালবাসার সম্পর্ক কী ভাবে গড়ে তোলা সম্ভব? কেমন করে পাঠ্যবই পড়ুয়ার কাছে ‘আমার বই’ হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়ে সারা পৃথিবীর শিক্ষাবিদেরা অনেক বছর ধরেই নানা গবেষণা করে আসছেন। সেখানেও নানা মুনির নানা মত। তবে একটি বিষয়ে বেশির ভাগই একমত— স্মৃতিনির্ভর মুখস্থকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীকে পাঠবিমুখ করে তোলে। ‘তোতাকাহিনী’ লিখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এই ধরনের বিদ্যালাভ প্রচেষ্টার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তা হলে বিকল্প ব্যবস্থা কী? ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক (২০০৫) প্রতিবেদনে পাঠ্যকে শিক্ষার্থীর জীবনকেন্দ্রিক করে তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছিল। পাঠ্যবস্তু যেমন হবে সহজ ও বোধগম্য, তেমনই শিক্ষার্থীর পারিপার্শ্বিক বিষয় ও উদাহরণ দিয়ে সাজানো, যা শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র মুখস্থ করে মনে রাখতে হবে না। বরং শিক্ষার্থী উৎসাহী হয়ে তার চেনা জগৎকে নতুনতর ভাবে আবিষ্কার করতে চাইবে। এবং যা হবে ফেল হওয়ার আশঙ্কামুক্ত। সেই সঙ্গে এনসিএফ-এর পরামর্শ অনুসারে, পাঠ্যবস্তুতে ‘নিজে করো’-র মতো হাতে-কলমে পরীক্ষার সুযোগ বেশি থাকলে শিক্ষার্থীর বিনোদনের উপকরণের অভাব হবে না। তখন তারা মোবাইলকে শেখার উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করবে, তাতে আসক্ত হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এনসিএফ-এর প্রতিবেদন প্রকাশের পর দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও এখনও এই রাজ্যে স্কুলস্তরের পাঠ্যবই জীবনকেন্দ্রিক হয়নি। বইয়ের প্রতি তাই শিক্ষার্থীদের তৈরি হয়নি ভালবাসার সম্পর্ক বা আবেগের বন্ধন। বইকে তারা শত্রু বলেই মনে করে। তাই পরীক্ষার শেষে মুক্তির আনন্দে বই ছিঁড়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া দেখে রাজ্যের সরকারি স্কুলস্তরের পাঠ্যবই প্রণেতারা কি এ বার একটু ভাববেন, না কি রাজ্যের গয়ংগচ্ছ শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন চলছে, তেমনটাই চলবে?
অনামিকা পাল, আমতা, হাওড়া
দুর্ভাগ্যজনক?
‘মাধ্যমিক শেষে বই, জামা ছিঁড়ে উল্লাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের এ-হেন আচরণে অনেক মানুষই উদ্বিগ্ন এবং মর্মাহত। বিশিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সর্বোপরি মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। বই এবং স্কুলের পোশাক ছিঁড়ে পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা শেষ হওয়া উদ্যাপন বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়ের হতশ্রী চেহারাটাই প্রতিফলিত করে, যার মূলে রয়েছে সমাজশিক্ষা, নীতিশিক্ষার অভাব। সমাজ উন্নয়ন কর্মী হিসাবে না বলে থাকতে পারছি না, এতে যেমন স্কুলশিক্ষকদের ব্যর্থতা আছে, তেমনই শুধুমাত্র তাঁদের দিয়েই এর সমাধান হবে কি না, তা ভাবতে হবে। নিঃসন্দেহে এই ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের লোকদের নজরদারি নেই। শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে নেই পারিবারিক, সামাজিক শিক্ষা এবং আচরণগত শৃঙ্খলতা। এর পাশাপাশি বিদ্যালয়ে পাঠদানের মধ্যে অভাব রয়েছে সামাজিক শিক্ষা, নীতি শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষা এবং দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের মানবিক প্রয়োগের শিক্ষা। শিক্ষা যদি হয় কেবল পরীক্ষায় পাশের জন্য, তা হলে পরিকল্পনার গোড়ায় রয়েছে গলদ। আর তখনই হারিয়ে যায় পড়ুয়াদের পরবর্তী জীবনে উত্তরণের পথ। আর এই হারিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক মনে হয় যখন সমাজতাত্ত্বিকদের একাংশ শিক্ষার্থীদের এই আচরণকে কেবলই দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেন। তা হলে, শিশুশিক্ষা, শিশু-উন্নয়ন তথা সমাজ উন্নয়নের পথ খুঁজবে কে?
শুভাশিস নন্দী, চন্দননগর, হুগলি
অবক্ষয়
মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ‘উৎসব’ পালন করল ছাত্রছাত্রীরা। এই ছবিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং বলা ভাল, এই অবক্ষয় রাজনীতির অবক্ষয়ের সঙ্গেই সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আগে টেবিল, চেয়ার, সিলিং ফ্যান ভাঙা হত। আর এখন বই ছেঁড়া হচ্ছে। এটা ব্যক্তিগত ক্ষতি, নীতির দুর্ভিক্ষ। এতে অবশ্য কৈশোরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পরিবার ভাঙছে, পারিবারিক সম্পর্কগুলিও শীতল হয়ে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক অনুশাসনের ভয় থাকছে না। বেপরোয়া মানসিকতায় হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ। নেতা-মন্ত্রীরা জনগণের করের টাকায় কেনা সংসদের চেয়ার টেবিল ভাঙাভাঙির খেলা খেলছেন, অন্যকে গালিগালাজ করছেন। কৈশোর কাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেবে? বরং ছেঁড়াছিঁড়ি, ভাঙাভাঙি ভাল করে জানলে আগামী দিনে রাজনৈতিক দলে ভাল কাজ করতে পারবে! কারণ, এখন বেশির ভাগ দলেই সভ্য সদস্যের থেকে অসভ্য মূর্খ সদস্যের কদর বেশি!
কৈশোর যে অস্থির, তা তো অজানা নয়। তাকে শিক্ষিত করতে হবে। বর্তমান সমাজে রোল মডেলের অভাব। যাঁরা মিডিয়ার প্রচারে উঠে আসেন, তাঁরা হয় কোনও না কোনও রাজনীতির রং মেখে বসে আছেন, নয়তো আগামী দিনে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ফলে সমাজে মানুষের উপর মানুষের বিশ্বাস কমছে। অন্য দিকে, চাকরির পরীক্ষায় লাগামছাড়া দুর্নীতিতে স্কুলগুলো আজ বন্ধ হতে বসেছে। শুধু পাশের হার বাড়ছে, মেধার জন্ম হচ্ছে না। এই অবক্ষয় আটকাতে না পারলে মানবসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান
মরীচিকা
সম্প্রতি মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষে কিছু ছাত্রের বই-খাতা ছিঁড়ে রাস্তায় উড়িয়ে উল্লাস প্রকাশের সংবাদ নজরে এসেছে। কোথাও আবার ‘কড়া গার্ড’-এর কারণে বোর্ডের পরীক্ষায় ঘাড় ঘোরাতে না পেরে বা ট্যাঁকে গোঁজা মাইক্রোজ়েরক্স-এর টিকিটি ছুঁতে না পারায় পাখা-বেঞ্চ-টেবিলের উপর ঘুষি-লাথি চালিয়ে গায়ের জ্বালা খানিক মিটিয়ে নিয়েছে। এই সমস্ত টুকরো ছবির কোলাজ আমাদের সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে আদর্শ, চেতনা, মূল্যবোধ-সহ সার্বিক অবনমনের তীব্র অভিঘাতের বহিঃপ্রকাশ। আজকের প্রজন্ম রক্ত-ঘাম বিনিয়োগ করে অর্জনের পরিবর্তে ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল’ নামক এক অতি পরিচিত ও অব্যর্থ অস্ত্র প্রয়োগ করে সহজ নিশানা করে চলেছে অসহায় অভিভাবকদের। তাই ‘যদি কিনে না দাও...’ কথা শেষ হওয়ার আগেই তাঁরা পড়িমরি করে দৌড়ে যান দোকানে সন্তানের দামি বাইক, দামি মোবাইল, স্মার্টওয়াচের বায়না মেটাতে। এই বিনিয়োগ দিয়ে এরা কী অর্জন করবে? চব্বিশ ঘণ্টা মোবাইল, সমাজমাধ্যম, টিকটকের রঙিন দুনিয়ায় ডুবে থেকে এরা কোন উচ্চতায় নিজেদের নিয়ে যাবে? প্রায়ই শোনা যায়, ‘পড়ে কী হবে?’ সত্যিই তো, পৃথিবী জুড়েই কাজের তীব্র হাহাকার। তার মধ্যেও অবশ্য বাবার ফুচকার দোকানে বা চাষের মাঠে হাত লাগিয়ে অনেক ছাত্র উত্তরণের পথ খুঁজে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তাই রঙিন দুনিয়ার ওই মরীচিকা যে দিন উবে যাবে, সে দিন কিন্তু কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া খুব একটা সহজ হবে না। নিজেকে মেরামতের সময়ও হয়তো পাওয়া যাবে না।
পলাশ মান্না, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর