প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘নগদ ভান্ডারেই ভরসা’ (৩১-১০) প্রবন্ধ সম্পর্কে কিছু কথা। আজকাল জনগণের হাতে, বিশেষ করে মহিলাদের হাতে কিছু নগদ টাকা দেওয়ার উদ্যোগ বিভিন্ন রাজ্যে শুরু হয়েছে ভোটবাক্সে ভোটের আশায়। যেমন পশ্চিমবঙ্গে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, মহারাষ্ট্রে ‘লড়কি বহিন’, মধ্যপ্রদেশে ‘লাডলি বহেনা’। একই পথে হেঁটেছেন তামিলনাড়ুর ডিএমকে সরকার, কেরলের বাম সরকার, তেলঙ্গানা ও কর্নাটকে একই রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। এই সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আবার প্রতিযোগিতা চলছে, কে বেশি নগদ টাকা মহিলাদের হাতে দিতে পারবে। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা অন্য রাজ্যগুলিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখন কথা হচ্ছে, রাজ্যগুলি এই ভান্ডারের টাকা দিচ্ছে বিপুল পরিমাণ ঋণ করে। তাই রাজ্যগুলি খোলা বাজারের ঋণে জর্জরিত। তবুও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করার জন্য এই দান-খয়রাতি চলছে।
বর্তমান রাজ্য সরকার যে সব সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে, সেগুলিকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু পাশাপাশি শিল্প ও কলকারখানা তৈরি করা, সরকারি দফতরগুলিতে স্বচ্ছ ভাবে, ঠিক সময়ে নিয়োগ করা দরকার। বেকার যুবক-যুবতীদের কাজের সুব্যবস্থা করে দেওয়া, পরিযায়ী শ্রমিক ও কৃষকদের নানান সুযোগ সুবিধা করে দেওয়া, রাজ্যের রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামতি করা, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা, বিদ্যুৎ বিলে কিছুটা ভর্তুকি, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামোর উন্নতি, স্বচ্ছ রেশন ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে দান-খয়রাতি নিয়ে আজ কোনও কথা বলারই সুযোগই বিরোধীরা পেতেন না।
প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন, আর জি কর কাণ্ডের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে আমজনতার জমে ওঠা ক্ষোভ বেরিয়ে আসতে দেখে বিজেপি ও বামেরা উল্লসিত। কথাটা ঠিক নয়। নগদ ভান্ডারের সঙ্গে আর জি করের ঘটনাকে মিলিয়ে দিলে চলবে না। এ কথা মনে রাখা দরকার যে, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া মেয়েরাও আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। ২০২৬-এর ভোটে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন শাসক-বিরোধী সব দলই দেখছে। সময়ই বলে দেবে নগদ ভান্ডারেই মহিলাদের ভরসা, না কি তাঁদের অন্তরে রয়েছে সন্তানদের বেকারত্বের যন্ত্রণা।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
খয়রাতির যুক্তি
প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, বিভিন্ন রাজ্যে নগদ-অর্থ প্রদান প্রকল্প— যাকে এক সময়ে ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বিদ্রুপ করতে ছাড়তেন না— তা ভোট-রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি যুক্ত। এর ইতিবাচক প্রভাব যে ইভিএম-এ পড়ে, এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। তার প্রমাণ আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ তো ইতিপূর্বে পেয়েছেই, অন্যান্য রাজ্য, বিশেষ করে, মহারাষ্ট্রও আসন্ন ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চলেছে ‘লড়কি বহিন’ প্রকল্পের হাত ধরে। যদিও, প্রায় সব ক্ষেত্রে ঋণের টাকাই মহিলাদের অনুদানের এই প্রকল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস। এই দিক দিয়ে দেখলে এটা মনে হতে পারে যে ক্ষমতাসীন দল রাজ্যের অর্থনৈতিক স্বার্থকে পুরোপুরি জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু নিজের স্বার্থটুকুই দেখছে, এই সব দান-খয়রাতির মাধ্যমে। কথাটা হয়তো পুরোপুরি ভুলও নয়। তার ইঙ্গিত প্রবন্ধকার তাঁর লেখাতেও উল্লেখ করেছেন, “কিছু স্বঘোষিত বামপন্থী ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’কে উৎকোচ হিসাবে তকমা দিয়েছিলেন।” এ বার দেখা যাক, এ ব্যাপারে অর্থনীতির তত্ত্ব কী বলছে? বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে আমেরিকাকে আর্থিক মন্দার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস-এর অভিমত ছিল, প্রান্তিক মানুষের হাতে যদি বাড়তি টাকা থাকে, তাঁরা বাজারে সেই টাকা ব্যয় করবেন এবং তাঁদের এই ব্যয়ের কারণে বিপুল চাহিদার সৃষ্টি হবে, যা পরিপূর্ণ করতে উৎপাদন বৃদ্ধি হবে এবং নতুন কর্মসংস্থান হবে। অর্থাৎ, প্রান্তিক মানুষের হাতে তাঁদের কল্যাণের জন্য পৌঁছে দেওয়া অনুদানের সুফল মধ্যবিত্তরাও ভোগ করতে পারবেন।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলোর গলাতেও এই একই সুর শোনা গিয়েছিল অতিমারির সময়ে। তখন এই দম্পতি বলেছিলেন, “এখন মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নয়। ক্রেডিট রেটিং কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও নয়। করোনায় ঘরবন্দি দেশে অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি বসে যাওয়া রুখতে প্রয়োজনে টাকা ছাপিয়ে দরিদ্রদের অ্যাকাউন্টে পাঠানো হোক।” এস্থারের মতেও, “ভারতে যখন জনধন অ্যাকাউন্টের মতো পরিকাঠামো রয়েছে, তা কাজে লাগানো জরুরি।” অর্থাৎ, দান-খয়রাতিতে দেশেরও লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। তবে, এই লাভটা আরও ফলপ্রসূ করতে যেটা প্রয়োজন, তা হল সরকারি ও বেসরকারি— উভয় ক্ষেত্রেই শিল্পোদ্যোগের সফল প্ৰয়াস। দুঃখের বিষয়, সেটারই বড় অভাব পশ্চিমবঙ্গে।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
লাদাখের কণ্ঠ
‘বলব যে, কণ্ঠটাই তো নেই’ (২৯-১০) শীর্ষক প্রবন্ধে শিশির রায় সঙ্গত ভাবেই লাদাখে লাদাখিদের অধিকারের কথা বলেছেন। লাদাখের দু’টি জেলা লেহ আর কার্গিল থেকে অন্তত দু’জন সাংসদ থাকা দরকার, যাঁরা তাঁদের এলাকার সমস্যা সংসদে বলতে পারেন।
ঠিকই, লাদাখ অন্য রকম। অত উঁচুতে পাহাড়িদের কর্মসংস্থান বা জলবায়ুর ব্যাপারে তাঁরা নিজেরাই সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন, দিল্লি বা সমতলের লোকজন দু’দিন বেড়াতে গিয়ে তাঁদের সমস্যা বুঝবেন না। কেন সংবিধানে বর্ণিত সিক্সথ শিডিউল প্রয়োগ করা হবে না, কেন গড়া হবে না অটোনমাস রিজনাল কাউন্সিল বা অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল, যে সুবিধাগুলি পান মেঘালয়, মিজ়োরাম, অসম, ত্রিপুরার মানুষজন, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। এই দাবিতেই সোনম ওয়াংচুক ও তাঁর সহযোগীরা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখেছি, কী কঠিন পরিশ্রম করে লেহ থেকে হেঁটে ওয়াংচুক ও তাঁর সঙ্গীরা তিন-চারটে প্রদেশ পেরিয়ে দিল্লি পৌঁছেছিলেন। তাঁরা ষোলো দিনের কঠিন অনশন চালানোর পরেও সরকার বাহাদুর আলোচনার সময় দিলেন ৩ ডিসেম্বর, সেখানেও যে সুরাহা মিলবে সে আশা তাঁরা করেন না। লাদাখিদের কষ্টের জীবন যেন অবহেলার অন্ধকারেই নিমজ্জিত থেকে যাবে।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ১৫ দিন ধরে লাদাখ ভ্রমণে লেহ, নুব্রা ভ্যালি, কার্গিলের জনজীবন দেখেছিলাম। দেখেছি, লাদাখি পরিবারগুলোতে স্ত্রী-পুরুষ সবাই ঘর-সংসার, বাড়ি-সংলগ্ন রুক্ষ মাটিতে চাষবাস, বাইরের কাজ সব কী পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন করছেন। তাঁদের জীবনে আরাম-বিশ্রাম বলে কিছু নেই। এক জন মহিলাকে দেখলাম সারা দিন প্রাথমিক স্কুলে পড়িয়ে, বাড়ির লোকেদের খাবার পরিবেশন করে, তার পর ছোট কোদাল নিয়ে চাষের মাটি কোপাতে লাগলেন। অথচ, অধিবাসীরা এত সরল আর ভালমানুষ যে, আমাদের জিপের স্থানীয় ড্রাইভারকে ফলন্ত গাছ থেকে আপেল পাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে তিনি তাঁর বাড়ির আপেল বাগানে নিয়ে গেলেন। আমরা ছ’জন ছ’টি পাকা আপেল পেড়ে নিলাম, কিন্তু তিনি কিছুতেই টাকা নিলেন না।
খারদুংলা যেতে সাউথ পোল্লেতে দোকানে খাবার খেতে গিয়ে দেখলাম— কিছু বাঙালি পর্যটক বিস্কুটের প্যাকেট ইত্যাদি যত্রতত্র ফেলে দিচ্ছেন, আর স্থানীয়রা সেগুলোকে কুড়িয়ে আবর্জনা ফেলার পাত্রের মধ্যে রাখছেন। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চলের অনেক বেশি মনোযোগ প্রাপ্য। লাদাখিদের অধিকার তাঁদেরই বুঝে নিতে হবে।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা