বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আর কত সইতে হবে’ (৩০-১১) প্রবন্ধে অতীতচারিতার পাশাপাশি উঠে এসেছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিও। ফলে প্রবন্ধটি তথ্যসমৃদ্ধ, সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক। মনে পড়ছে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর বাংলাদেশ ভারত সরকারের সম্মতিক্রমে ১৯৭২ সালে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে সপরিবারে নিয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে তারা কবিকে ‘জাতীয় কবি’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁরই কণ্ঠে ধ্বনিত— “হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
সেই বাংলাদেশ, আমার বঙ্গের সঙ্গে যার নাড়ির যোগ সেখানেই আজ রক্তগঙ্গা বইছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সংখ্যালঘু হিন্দু আর পাহাড়তলির বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার দিন দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। প্রতিহিংসায় জ্বলতে থাকা কট্টর মৌলবাদী সম্প্রদায় ধর্মকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক পাশা খেলায় মত্ত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্তে ভারতীয় অসংখ্য সেনার বলিদানের বিনিময়ে বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা পেল সেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে দিতে চাইছে। সমকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী পাকিস্তানের ‘মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্ট’ পদ্মা-মেঘনা বিধৌত ভূখণ্ডে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ইতিহাসবিদরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কে আর্মেনীয় গণহত্যার সঙ্গে এর তুলনা করেছেন। সেখানেও প্রায় পনেরো লক্ষাধিক আর্মেনীয় সম্প্রদায়কে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই গণহত্যার নায়কদের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের অ-নির্বাচিত নায়কদের পার্থক্য কোথায়? অকারণে ‘ভারতে পাঠাব’ স্লোগানের হুঙ্কার। মোবাইল কেড়ে নিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না— চলছে যাচাই! বাঙালির সংস্কৃতির ধারক-বাহক ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙচুর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি দখল, রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানের নাম বদল, লালন প্রতিষ্ঠিত আখড়ায় ভাঙচুর দখল হতবাক করে দিচ্ছে। টর্নেডোর মতো ধেয়ে আসা ছাত্র-আন্দোলন বা ‘গণ-অভ্যুত্থান’-এর মধ্যে সমালোচকরা পূর্বপরিকল্পিত ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িকতার রহস্য খুঁজে পাচ্ছেন। আজ রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সঙ্গীত না রাখার কট্টরপন্থীদের হুঙ্কারে সন্ত্রস্ত হতে হয়। ব্যথিত হই ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননায়।
প্রতিকারের জন্য সরব হতে হবে। দায়ভার সরকারের। মানুষ যখন, যেখানে প্রচলিত ধর্মের গোঁড়ামিকে ছাড়িয়ে যায় সেখানেই মিলন সহজ ও অবাধ হয়।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
পরিণাম
কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘আর কত সইতে হবে’ অনেক ভাবনার জন্ম দিল। বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্মম অত্যাচার চলছে, তার পরিণাম কী হতে পারে, তা চিন্তা করলে শঙ্কিত হতে হয়। মানুষমাত্রেই জানেন যে প্রতিটা অন্যায়ের শুরুর পর তার একটা শেষও আসে। হিটলার ইহুদিদের উপর নির্মম অত্যাচার করে শেষ পর্যন্ত কিন্তু রেহাই পাননি। পাকিস্তান থেকে হিন্দুদের জবরদস্তি বিতাড়িত করে মহম্মদ আলি জিন্না শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করতে পারেননি। উত্তর ভারতে মুসলমানদের উপর যে নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে বা হচ্ছে, সেটাও যেমন নিন্দনীয়, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্মম অত্যাচার হচ্ছে, বা হয়েছে সেটাও সমান নিন্দনীয়। এই দাবি তুলছি না যে, শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে হিন্দুরা খুব আনন্দে দিন কাটাতেন বা তাঁদের উপর অত্যাচার হত না। কিন্তু হাসিনার দেশত্যাগের পরে এখন বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের মাত্রা দশ গুণ বেড়ে গিয়েছে। কারণ, এদের ভয় সংখ্যালঘুদের উৎখাত করা না গেলে বাংলাদেশ কোনও দিন ইসলামিক রাষ্ট্র হতে পারবে না। অনেকের বক্তব্য, শেখ হাসিনাও মনে মনে তা-ই চাইতেন। যার জন্য তিনি সাধারণ নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন। একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছিলেন বাংলাদেশকে। ঠিক সময়েই তিনি দেশটাকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতেন। আর ইসলামিক রাষ্ট্র হলে আরব দেশগুলি থেকে প্রভূত সাহায্য মিলবে।
কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে অনভিজ্ঞ মুহাম্মদ ইউনূস সময়ের দাবি বুঝতে পারছেন না, যা হাসিনা বুঝতেন। ভারতের থেকে বাণিজ্যিক সাহায্য বন্ধ হলেই চিনের বাণিজ্যিক সাহায্য পাওয়া যাবে না। শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়, এই প্রবাদটা সব ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। চিন নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাইছে, কারণ ওই দু’টি দেশ ভারত-ঘনিষ্ঠ। আর ওই দেশ দু’টির সঙ্গে চিনের কয়েক হাজার কিলোমিটার সীমান্ত আছে। সেখান দিয়ে ভারত আক্রমণ করলে চিনের বিপদ বাড়বে, তাই নেপাল ভুটানের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাইছে চিন। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে চিনের তেমন লাভ নেই। আর কোনও দেশ নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। ইউনূস ভাবছেন আরব দেশগুলি থেকে কম দামে খনিজ তেল পাবেন। ভুল ধারণা। আরব দেশগুলি উপযুক্ত দাম ছাড়া খনিজ তেল কোনও দেশকে বেচে না। পাকিস্তান ইসলামিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও আরব দেশগুলি থেকে উপযুক্ত মূল্যেই খনিজ তেল পায়।
ইউনূসের উচিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বন্ধ করা। ইতিমধ্যে ভারত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এই প্রতিবাদকে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং আমেরিকা সমর্থন করেছে। যদি বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাঁচানোর জন্য যৌথ বাহিনী পাঠাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়, তা হলে চিন ভেটো দিলেও বাংলাদেশে যৌথ বাহিনী ঢুকবে।
কোনও ধর্মের সাধারণ মানুষ কখনও অন্য ধর্মের প্রতি আক্রমণ করেন না। কিছু স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্য ধর্মের প্রতি আক্রমণ করতে উৎসাহ জোগায়। যাঁরা এখন চুপ আছেন, তাঁরা কিন্তু আর বেশি দিন সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার সইবেন না।
কমল চৌধুরী, কলকাতা-১৪০
বিচারের বাণী
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আর কত সইতে হবে’ প্রবন্ধটি বড়ই প্রাসঙ্গিক। ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া একটি দেশের বর্তমান প্রজন্ম দ্বিতীয় স্বাধীনতার নামে এক চরম নৈরাজ্য এবং স্বৈরাচারের জন্ম দিয়েছে। একটি দেশের চালিকাশক্তি তরুণ প্রজন্ম। তারাই দেশের অর্থনৈতিক বনিয়াদকে মজবুত করে। অথচ তারাই বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কুপথে পরিচালিত হচ্ছে এবং কুকাজে লিপ্ত হচ্ছে। এই অস্থির সময়ে বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা দেশের সুস্থ সংস্কৃতি, ইতিহাস, সৌভ্রাত্র, সহিষ্ণুতা, সব কিছুকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছে। ইসকনের মতো সমাজসেবী একটি প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার অপচেষ্টা চলছে। তাদের দাবি-দাওয়াকে অযৌক্তিক মনে করে ইসকনকে কালিমা লিপ্ত করা হচ্ছে এবং ইসকনের সদস্যদের আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে আক্রমণ করা হচ্ছে নির্লজ্জ ভাবে।
বাংলাদেশে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের অস্তিত্ব লুপ্ত মনে হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের যে মানুষেরা বাংলাদেশে জন্মেছেন, তাঁদের স্বদেশ ছাড়তে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কতটা ভারত-বিদ্বেষ থাকলে আমাদের জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা যায়, সেটা তো নিজেদের চোখেই দেখলাম। আন্তর্জাতিক আদালতে এর বিচার হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা, জাতীয় সঙ্গীত বদলের দাবি, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সংস্কৃতিকে নির্মূল করার প্রয়াস চলছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে শপথ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। স্থৈর্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়তে হবে।
রতন নস্কর, সরিষা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা