‘পাশ-ফেল’ (৩-১) শীর্ষক সম্পাদকীয় বিষয়ে কিছু কথা। ২০০৯ সালে এ দেশে ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যে ‘নো ডিটেনশন পলিসি’ চালু হয়েছিল তাতে ছাত্রছাত্রীরা অবাধে পাশ করার অধিকার পেয়েছিল ঠিকই, তবে শেখার অধিকার থেকে তারা হয়েছিল বঞ্চিত। সেই থেকে কার্যত কিছু না শিখিয়েই বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়েকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত জবরদস্তি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে নবম শ্রেণির পর দেখা গেছে ভয়াবহ হারে স্কুলছুট। আট বছর ধরে যারা অকৃতকার্য হওয়ার ভাবনাকে কোনও রকম আমল দেয়নি, হঠাৎ তারা যখন সামনে দেখে ফেল-এর হাতছানি, তখন পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খুঁজে পায় না।
এ রাজ্যে বামফ্রন্টের শিক্ষানীতি, যেখানে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি এবং পাশ-ফেলকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ভাষাচার্য সুকুমার সেন বলেছিলেন কাগজের এক পিঠ থেকে আর এক পিঠকে যেমন আলাদা করা যায় না, তেমনই পরীক্ষা এবং তার অনুষঙ্গ পাশ-ফেল থেকে লেখাপড়াকেও আলাদা করা যায় না। সে দিক থেকে প্রতিটি ক্লাসেই পাশ-ফেলের একটা গুরুত্ব রয়েছে। অথচ, এখানে কেবল পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল চালু করার ফরমান এসেছে। যে কারণে পাশ-ফেলকে ত্যাগ করার পর আবার গ্রহণ করা হল, সেই কারণেই তো প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসেই পাশ-ফেল প্রথার পুনঃপ্রবর্তন ছিল জরুরি। ভীতি ধাপে ধাপে কাটানোই বিজ্ঞানসম্মত। নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন, যা ছাত্রছাত্রীদের কাছে জরুরি, তার রূপায়ণ করতে গেলে যে শিক্ষকসংখ্যা দরকার, সঠিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক দরকার, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো দরকার, তা যত দিন না হচ্ছে, তত দিন প্রতি ক্লাসে ষাণ্মাসিক ও বাৎসরিক পরীক্ষা এবং সেই অনুযায়ী ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের যত্ন নেওয়া নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়নের অনেক কাছাকাছি চলে যেতে পারে।
পরিশেষে বলি, জীবনে চলার পথে আমাদের পদে পদে নানা পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। সেখানেও আছে পাশ-ফেল। ছোটরা যখন দাঁড়াতে শেখে, চলতে শেখে কত বার পড়ে যায়। পাশ বা ফেলকে কোন দৃষ্টিতে দেখব, ফেলকে ‘সামাজিক বিদ্রুপ’ হিসাবে অভিহিত করব কি না, তার ভিত্তিতে আমাদের ভূমিকা নির্ণয় করতে হবে। গোড়া থেকে শিখলে তবেই সেই শিক্ষার কার্যকারিতা বেশি থাকে।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
ক্ষতির শিকার
পাশ-ফেলের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে সম্পাদকীয়ের বক্তব্য খুবই যুক্তিযুক্ত। বছর দুই আগে আমার এক নিকট আত্মীয় তাঁর ছেলের জন্য ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়ে ফর্ম ফিল-আপ করতে দিয়েছিলেন আমাকে। সে কাজ করে যখন নবম শ্রেণির ছেলেকে ফর্মে ইংরেজিতে নিজের নাম সই করতে বলি, তখন সে ইতস্তত করতে থাকে। তার পর বলে ইংরেজিতে পারবে না। বাংলায় করবে। বাংলায় সই করতে অনুমতি দিলে দেখা গেল, বাংলাতেও নিজের নাম ভাল করে লিখতে পারছে না। হাত কাঁপছে। অসমান অক্ষর। ঘষে ঘষে অনেক সময় নিয়ে বাংলায় নিজের নাম লিখল ফর্মে।
ভাবতে অবাক লাগে, প্রথম শ্রেণি থেকেই নবম শ্রেণিতে উতরে গেল একটি ছাত্র, অথচ সে ইংরেজিতে নিজের নামটি পর্যন্ত লিখতে শিখল না? স্কুলের মাস্টারমশাইরা তা হলে কী করছিলেন? তবে কি শুধুমাত্র একের পর এক ক্লাস উতরে দেওয়াই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য? পাশ-ফেল প্রথা চালু থাকলে কিন্তু এমনটি হত না। আগেই ছাত্রের দুর্বলতা ধরা পড়ত এবং সেই ভাবে শিক্ষকরা শেখানোর ব্যবস্থা করতেন। আর পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার ফলে এক শ্রেণির শিক্ষকশিক্ষিকাও যে অনেকটা দায়সারা গোছের হয়ে পড়েছিলেন, তা-ও কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। সরকার নাহয় নতুন করে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল চালু করল, কিন্তু যে সব পড়ুয়া এত দিন পাশ-ফেল প্রথার বাইরে থেকে পড়াশোনা করে ক্ষতির শিকার হল, তাদের ক্ষতি পূরণ করবে কে?
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি
পরিবর্তন জরুরি
‘পাশ-ফেল’ সম্পাদকীয়তে খুব সঙ্গত কারণেই উল্লেখ করা হয়েছে— শিক্ষার উদ্দেশ্য যখন শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়ন, তখন মূল্যায়নটিকেই অপ্রাসঙ্গিক করে না তুলে তার সঙ্গে জড়িত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রচেষ্টা জরুরি। পাশ-ফেলের পক্ষে এবং বিপক্ষে যে যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, প্রাথমিক শিক্ষার পরিকাঠামো সঠিক ভাবে উন্নতিতে সরকার যদি কোনও পদক্ষেপ না করে, ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ কথাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রাথমিকে সিমেস্টার চালু নিয়ে আমাদের রাজ্যে অনেক জলঘোলা হয়েছে এবং মুখ্যমন্ত্রীর অভিমতকে মান্যতা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও অনুরোধ, এই ধরনের বিষয়ে শিক্ষাবিদদের মতামতকেই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। বাস্তবে পাশ-ফেল তুলে দেওয়া, মিড-ডে মিল, কন্যাশ্রী চালু করেও শিক্ষাকে যেমন সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া যায়নি, তেমনই কমেনি বাল্যবিবাহ। শিক্ষার মানোন্নয়নে তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকার ও সরকারপোষিত বিদ্যালয়ে যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষক এবং একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পড়ুয়াদের মূল্যায়ন এবং এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মতামত। সরকারের বর্তমান শিক্ষা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন না ঘটলে আগামী দিনে শিক্ষা শুধুমাত্র অর্থবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
নাগরিক উদ্যোগ
‘সম্ভাবনার পুনর্জন্ম’ (৩১-১২) সম্পাদকীয়তে যথার্থই বলা হয়েছে যে, আর জি করের চিকিৎসক-ছাত্রীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যে সুদীর্ঘ সামাজিক বিক্ষোভ ঘটে গেল, তা অভূতপূর্ব সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। তথাকথিত সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্ব ছাড়াও যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে, এ আন্দোলন তা প্রমাণ করেছে। মানুষের নিজস্ব চেতনা, সামাজিক দায়িত্ববোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বাভাবিক মানসিকতাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কেউ কেউ একে মধ্যবিত্তের আন্দোলন হিসাবে দাগিয়ে দিতে চান। সত্যিই কি তা-ই? সমাজের নানা অংশের বিশেষত নিম্নবিত্ত প্রান্তিক মানুষও দলে দলে, সপরিবারে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। দৈনন্দিন জীবনে, কর্মস্থলে ব্যক্তির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বঞ্চনা ও অপ্রাপ্তির ঢেউগুলি মিশে গিয়েই তৈরি হয়েছে আন্দোলনের এমন উত্তাল জোয়ার। সাধারণ মানুষের আন্দোলন বলেই এই আন্দোলনের সামনে কোনও প্রখ্যাত নেতার, কোনও বিশেষ ব্যক্তির নাম শোনা যায়নি। এটা গণআন্দোলনের একটা নতুন দিককে চিহ্নিত করেছে। ভোটে জেতার পরিবর্তে দাবি আদায়ই এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হিসেবে থাকায় বিরোধী দলগুলি একে নির্বাচনী রাজনীতির স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
এমন আন্দোলনের আর একটি রূপ দেখা গিয়েছিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে। সে দিনও আর এক আধিপত্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে মানুষ এমন করেই ফেটে পড়েছিল। কিন্তু সেই আন্দোলন ছিল মূলত সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। তাই সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা স্তিমিত হয়ে যায়। কিন্তু আর জি কর আন্দোলন তো তা নয়। এখানে অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবির সঙ্গে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মিশে যাওয়ায় এ আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েই গড়ে উঠেছে। কিন্তু তা কতখানি বাস্তবে পরিণত হবে তা নির্ভর করছে সম্পূর্ণরূপে নাগরিক উদ্যোগের উপর।
সমর মিত্র, কলকাতা-৪