অমিতাভ গুপ্তের ‘দল নয়, সরকার’ (২৬-১১) প্রবন্ধটি সম্পর্কে কিছু কথা। সাম্প্রতিক ছ’টি উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয় তাদের আর জি কর আন্দোলনের নাভিশ্বাস অবস্থা থেকে কিছুটা অব্যাহতি দেবে, সন্দেহ নেই। লক্ষ্মীর ভান্ডার, না মমতা-ম্যাজিক, কিসের জোরে এই জয়— প্রশ্নটি বার বার আলোচনায় উঠে আসছে। সাধারণ ভাবে বলা যায় উভয়ের গুরুত্ব সমান। এ ছাড়া শাসক দলের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হল স্থানীয় ক্ষেত্রে কাটমানি-পুষ্ট দাদা ও তাদের দাদাগিরি, যা ভোটযুদ্ধে বিরাট ভূমিকা পালন করে। তার উপরে আছে তথাকথিত শহুরে ভদ্রলোক শ্রেণি, যাঁরা ভোট প্রদানে বিরত থেকে পরোক্ষে শাসক দলের সুবিধা করে দেন। এ ছাড়া আছে বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিএমের পরস্পর-বিরোধিতা এবং দিশাহীন দুর্বল প্রচার। অন্য দিকে, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রাপ্ত দরিদ্র মেয়েরা এটাকে খানিকটা মুক্তির ভান্ডার মনে করেন। তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা, এই শাসক দল ব্যতীত তাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডারের ন্যূনতম সুবিধাটুকু থেকে বঞ্চিত হবেন। অতএব লক্ষ্মীর ভান্ডারের জয়জয়কার। কিন্তু লক্ষ্মীর ভান্ডার একটি সরকারি প্রকল্প এবং এই প্রকল্প থেকে কোনও বিরোধী দল কোনও দিন কাউকে বঞ্চিত করবে না, এমন নিরাপত্তার আশ্বাস কোনও দলই সে ভাবে সাধারণ মানুষকে শোনায়নি। পরিণামে সরকারি শাসক দলের প্রবল দুর্নীতি মান্যতা পেয়ে যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের দুর্নীতি উপেক্ষায় এবং মমতা নির্ভরতায়।
প্রসঙ্গত, ‘দিদিকে বলো’ ও ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ কার্যক্রম মোটেও দলকে ‘বাইপাস’ করে হয় না বা তা দল-বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষ তা যথেষ্ট অবগত। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও মানুষের কাছে যতটা গ্রহণযোগ্য, তেমনটি আর কেউ নয়। তাই এই দলের এত রমরমা। অন্য দলগুলি থেকে যত ক্ষণ না কেউ তাঁর সমকক্ষ হতে পারছেন, তত ক্ষণ এই ছবি পাল্টাবে না।
তপন কুমার দাস, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
প্রশাসনকে ভোট
অমিতাভ গুপ্ত যে দুর্নীতির গণতন্ত্রীকরণের কথা বলেছেন, সে তো বরং বাম জমানায়। কংগ্রেস আমলে দুর্নীতি ছিল উপরমহলে। বামেরাই তাকে পঞ্চায়েত স্তরে নামিয়ে এনেছেন। এই আমলে বিভিন্ন মাপের মনসবদারদের কথা বলা হয়েছে, যাঁরা রাজ্যের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-বালি-ভেড়ি সর্বত্র বিরাজমান। যাঁদের লুটের পরিমাপহীন অংশ নিয়ম করে পৌঁছয় রাজ দরবারে। বর্তমান শাসকের যে দুর্নীতিভিত্তিক শাসননীতি, ক্ষমতা বিন্যাস সেখানে ধাপে ধাপে প্রজা স্তরে পৌঁছয় না। কেন্দ্রের সঙ্গে ব্যাসার্ধের যে যোগ, ব্যাসার্ধের সঙ্গে পরিধির, তা একান্তই ব্যক্তিগত, দলগত সম্পর্কের নয়। প্রবন্ধে যথার্থই বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত স্তরে তা সেই কারণেই পরস্পর-বিচ্ছিন্ন। একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। যৌথ ভাবে শীর্ষকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তাঁদের নেই।
কিন্তু এত সত্ত্বেও ভোটে তার প্রভাব পড়ে না। কারণ, প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরভিত্তিক উন্নয়ন নীতি। মানব উন্নয়নে বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও তার তাৎপর্যপূর্ণ সুপ্রভাব পড়েছে। কিন্তু একে কি সত্যিই মানব উন্নয়ন বলা যায়? প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তর তো জানি ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ বা ‘সর্বজনীন মূল আয়’-এর অনুষঙ্গে। রুজিরোজগারের প্রশ্নে, ধনতন্ত্রে অসমাধানযোগ্য সঙ্কট সমাধানে যার অবতারণা। এ দেশে যার পরিমাণ দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে প্রত্যেকের ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা হওয়া উচিত, অন্যান্য সব প্রাপ্ত সামাজিক সুবিধা অক্ষুণ্ণ রেখেই। এ রাজ্যে মহিলাদের জন্য বরাদ্দ ৫০০-১,০০০ টাকা কি তবে সকলের রোজগারের অধিকারের সেই সামাজিক দায় মেটাতে? তা না হলে সেই সামান্য অনুদানের বিনিময়ে মানুষের প্রাপ্য অধিকারের দাবিগুলি থেকে বঞ্চিত করে তাঁদের ঠকিয়ে ভোট নিয়ে নেওয়া হচ্ছে না কি?
শিবপ্রসাদ দাস, আন্দুল মৌরি, হাওড়া
জনবাদী
তৃণমূল কংগ্রেস সিপিএম কিংবা বিজেপির মতো ‘রেজিমেন্টেড’ দল নয়। তাই দলীয় শাসনে উল্লম্ব ব্যবস্থার পরিবর্তে অনুভূমিক বিন্যাসই প্রাধান্য পায়। দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণে দলকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা কিংবা বুথভিত্তিক দলের ছেলেপুলেদের তুষ্ট রাখার আধারেই তৃণমূল কংগ্রেসের ন্যায় রাজনৈতিক দলগুলির জিয়নকাঠি লুকিয়ে রয়েছে। বস্তুত, এই দলগুলির শুধুমাত্র জনবাদী হয়ে ওঠার পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে সাফল্যের রহস্য। মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর হাত ধরেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের বাড়বাড়ন্ত। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, কেরল, তেলঙ্গানা সর্বত্রই এই প্রকল্পগুলিতেই আস্থা রেখেছে শাসক দল। অর্থাৎ, দুর্নীতির পারাবার পেরিয়ে কিঞ্চিৎ অর্থ সরাসরি নাগরিকদের নিকট পৌঁছচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক মনসবদারদের আধিপত্যবাদ জনগণ প্রত্যক্ষ করলেও পরিশেষে নগদ ভান্ডারে ভরসা রেখেই শাসক দলের জয়ধ্বজা উড্ডীন থাকে। জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের জুড়ি মেলা ভার। তাই শাসক দলের নেতাকর্মীরা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হলেও রাজ্যবাসী দলকে ভোট দিয়ে সরকারকে জেতান। ভোটে জেতার স্বপ্নে শাসক-বিরোধী কেউই অদূর ভবিষ্যতে অনুদান প্রকল্পগুলিকে বন্ধ করতে পারবেন না। তাই বর্তমানে নগদ অর্থের মাধ্যমে ভোটারদের মন জয় করা জনবাদী রাজনীতির অন্যতম শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
দুর্দিন আসন্ন
মানুষ ভোট দেওয়ার সময় দলের সমস্ত দুর্নীতি ভুলে সরকারকেই বেছে নেন, অমিতাভ গুপ্তের এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া গেল না। সমাজমাধ্যমে সরকারের অনৈতিকতার সমালোচনা করব, প্রতিবাদী মিছিলে পা মেলাব, আবার সেই সরকারের পক্ষেই ভোট দেব, একে সুবিধাভোগী মানসিকতা, না দ্বিচারিতা, কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, তার সঠিক উত্তর জানা নেই। তবে ভোটের ফলাফল বলে, এঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাজ্যের অসংখ্য মানুষ প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরভিত্তিক উন্নয়ন নীতির যে সুবিধা ভোগ করছেন, সেটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বলা যেতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ প্রশাসন-নির্ভর বলে প্রবন্ধে যে উল্লেখ করা হয়েছে, তা মোটেই সঠিক নয়। সেই সুবিধাগুলি পেতে হলে স্থানীয় স্তরে কাটমানি বিলক্ষণ দিতে হয়। মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, কর্নাটক, তেলঙ্গানা প্রভৃতি রাজ্যেও ভোটের ফলাফলে নগদ হস্তান্তরের প্রভাব যে অপরিসীম, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তা স্বীকার করে নিয়েছেন। এই ধরনের অনুদানমূলক প্রকল্পের জন্য জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না, এই কথা প্রকাশ্যে বলার জন্য কর্নাটকে কংগ্রেস সরকারেরই এক বিধায়ক দলের শো-কজ়ের আওতায় পড়তে চলেছেন বলে খবরে প্রকাশ।
এর সঙ্গে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিয়মভঙ্গের অবাধ স্বাধীনতা সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত যে ভাবে বিব্রত করে চলেছে, তাতে প্রবন্ধে উল্লেখ করা কথাই আবার বলতে হয়, বাস্তবকে অস্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি অথবা দুর্নীতিকে বোঝার উপায় নেই। এই অবস্থা চলতে থাকলে, আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে রাজনীতির এই বাস্তবতাকে দূরে সরিয়ে সমস্ত সাধারণ মানুষের ভাবনায় একই প্রতিফলন ঘটানো বাস্তবিকই জরুরি।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি