TET Protest

সম্পাদক সমীপেষু: কলঙ্কের অধ্যায়

আজ বাংলার গোটা শিক্ষা দফতরের অনেক আধিকারিক গারদে। আদালতে বিচার হবে, কে দোষী আর কে নির্দোষ। কিন্তু এই দশ বছরে দু’টি প্রজন্ম প্রায় শেষ হয়ে গেল, তার দায় কে নেবে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২২ ০৫:০০
পনেরো মিনিটের অপারেশন।

পনেরো মিনিটের অপারেশন। ফাইল চিত্র।

‘অমানবিকতার এই মুখ’ (২৬-১০) শীর্ষক অনিতা অগ্নিহোত্রীর প্রবন্ধটি পড়ে নিজেকে এক জন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে সত্যিই লজ্জাবোধ করছে। আজ বেশ কয়েক বছর হতে চলল এসএসসি, টেট, গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা বিভিন্ন সময়ে কলকাতার রাজপথে শুয়ে আন্দোলন করছেন। সেই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে পুলিশ লাঠি চালিয়ে প্রিজ়ন ভ্যানে তুলছে আন্দোলনকারীদের। আবার গভীর রাতে অতি গোপনে ঘুমন্ত অবস্থায় লজ্জাজনক ভাবে টেনেহিঁচড়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিচ্ছে, আর বাংলার অধ্যাপক, শিক্ষক সমাজকে অসহায় ভাবে নীরব দর্শক হয়ে দেখতে হচ্ছে— এটা বড় দুঃখের, বেদনার। যাঁরা হুকুম দিচ্ছেন এবং যাঁরা সেই হুকুম পালন করছেন, তাঁরাও এক দিন কোনও না কোনও শিক্ষকমশাইয়ের কাছে পড়াশোনা করে আজ এই জায়গায় এসেছেন। এই কথাটা ভুলে যাওয়া অমানবিক। মনে রাখতে হবে, এই হবু শিক্ষকরা ভিক্ষা চাইতে আসেননি, এসেছেন যোগ্যতার নিরিখে যোগ্যতম শিক্ষক হতে। কোনও দেশের শিক্ষা দফতরেই নিম্ন মানের ব্যক্তিরা নিযুক্ত হতে পারেন না। কারণ, এই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটা জাতির মেরুদণ্ড ও ভবিষ্যৎ। আজ বাংলার গোটা শিক্ষা দফতরের অনেক আধিকারিক গারদে। আদালতে বিচার হবে, কে দোষী আর কে নির্দোষ। কিন্তু এই দশ বছরে দু’টি প্রজন্ম প্রায় শেষ হয়ে গেল, তার দায় কে নেবে? চিরদিন কেউ ক্ষমতায় থাকে না, থাকবেও না। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় আজ যে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হল, জনতার আদালতে তার বিচার হওয়া উচিত।

স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

Advertisement

দুর্নীতির স্রোত

‘অমানবিকতার এই মুখ’ একটি সময়োপযোগী প্রবন্ধ। রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থার উপর ধারাবাহিক আক্রমণ এবং আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর পুলিশি নিপীড়ন রাজ্য সরকারের হিংস্র মানসিকতাই প্রমাণ করে। সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার হল, গোটা শিক্ষা দফতরটাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে। ইডি বা সিবিআই হস্তক্ষেপ না করলে এই দুর্নীতির স্রোত একই ভাবে প্রবাহিত হত। বেআইনি নিয়োগ করে লক্ষ-কোটি টাকা উৎকোচ হিসেবে পাওয়ার চেষ্টা কোথায় গিয়ে যে শেষ হত, কে জানে! বেআইনি নিয়োগে দু’একটি রাঘববোয়াল ধরা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু যত জন দোষী ধরা পড়েনি, তাদের প্রকৃত সংখ্যাটা কত, ভবিষ্যৎই বলবে। যাঁদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁদের যোগ্যতাও পরীক্ষিত হয়নি, বেআইনি ভাবে অর্থ এলেই হল! চাকার নীচে রাস্তায় শুয়ে থাকা যুবক-যুবতীদের আন্দোলন চলতে থাকলে, তাকে কেন্দ্র করেই আরও দুর্নীতি প্রকাশ হতে পারে, সেই ভয় সম্ভবত এই সরকারের আছে। এই আন্দোলনের মধ্যে পুজোর কার্নিভাল ঘোষণা করা, এবং তা চলতে দেওয়া, কি সরকারের নিষ্ঠুরতার নিদর্শন ছিল না?

অমরেন্দ্র নাথ ধর, কলকাতা-৫১

সঙ্কীর্ণতার শিক্ষা

অনিতা অগ্নিহোত্রীর প্রবন্ধ মর্মস্পর্শী এবং হৃদয়বিদারক। শিক্ষিত এবং শিক্ষক পদের যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক দল যুবক-যুবতী চাকরি না পেয়ে এক বছরের অধিক সময় ধরে কলকাতার রাজপথে আন্দোলন করছেন, অথচ সেই রাজ্যে শিক্ষিত সমাজের মননে বিষয়টি একটুও রেখাপাত করছে না, এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কী থাকতে পারে! কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রতি দিন নতুন অভিযোগ আনছে রাজ্য শিক্ষা দফতরের কর্তাদের বিরুদ্ধে, আর বিপরীতে রাজ্যে মেলা-খেলা সব কিছু চলছে। উত্তরবঙ্গের মানুষ হড়পা বানে ভেসে গেলেও উৎসবপ্রিয় কলকাতার মানুষ মেতেছেন দুর্গাপুজো কার্নিভালে। অর্থাৎ, সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক হয়ে ওঠার সহজাত প্রবৃত্তিগুলি যেন বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে! এ কোন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা? উত্তর প্রজন্মকে কী শেখাচ্ছি? শুধু নিজস্ব সুখ, আনন্দ, বৈভব নিয়েই জগৎ!

প্রবন্ধকার শিক্ষাক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা এবং নৈরাজ্য নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও সরকারের উদাসীনতার কারণে আশাহত হয়েছেন। হওয়ারই কথা। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, এই সরকারের মেয়াদের অবসানে নতুন যাঁরা আসবেন, তাঁরা কি স্বচ্ছতা বজায় রাখবেন? এই যে টেট পরীক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে ধর্না দিতে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এমন আন্দোলন ভাবাও অসম্ভব ছিল। প্রাইমারি স্কুলের চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত না তখন। কিন্তু প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হত। কারা পেতেন সেই সব? ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চাকরি-বঞ্চিত প্রার্থীদের সংখ্যাও কম নয়। অর্থাৎ, দলীয় একটি ছাপ না থাকলে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছেটুকু পরিত্যাগ করতে হবে। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষকের পদে আসীন রয়েছেন এমন মানুষেরা, যাঁরা অযোগ্য। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য, তবে এ ভাবেই বহু অযোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা গত শতাব্দীর শেষ ভাগে শুধু দলীয় আনুগত্য দেখিয়েই চাকরি করে অবসর নিয়েছেন। আসলে বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে রাজনীতি করা যায়, কিন্তু ন্যায় পাইয়ে দেওয়া যায় না!

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

নির্লিপ্ত প্রশাসন

‘অমানবিকতার এই মুখ’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে দু’-একটি কথা। শিক্ষাব্যবস্থার উপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলেছে গত এক দশক ধরে। নতুন সরকার আসার পরই শুরু হয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিগ্রহের মতো ঘটনা, যার মূলে ছিল তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন। এর পর কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে হলে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হত। টাকা দিতে অপারগ হওয়ার জন্য অনেক ছাত্রছাত্রীর আর উচ্চশিক্ষার মুখ দেখা সম্ভব হয়নি। শোনা যায়, এ ভাবে তোলা টাকার বড় অংশ চলে যেত দলের উপরমহলের কাছে। শিক্ষায় এ ধরনের বর্গি হানা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় কবে কে দেখেছেন? প্রশাসনিক অমানবিকতা, নির্লিপ্ততা নিয়ে এখন যেন এ রাজ্যের নাগরিক সমাজ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তা না হলে বিসর্জনের সময়ে মাল নদীতে হড়পা বানে যখন বেশ কিছু মানুষ ভেসে গেলেন, নিখোঁজ হলেন, তার কোনও হিসাব না নিয়ে, তড়িঘড়ি ঘোষণা হল কার্নিভালের। দুর্গাপুজোর আগে এক বার হেরিটেজ স্টেটাস পাওয়ার জন্য উৎসব হল এবং স্কুল-কলেজ, অফিস ছুটি হয়ে গেল। মালবাজারে হড়পা বানে হারিয়ে যাওয়া লাশগুলির ক্ষতিপূরণ যখন টাকার অঙ্কে নির্ধারিত হচ্ছে, তখন বাকি রাজ্য উৎসবে মাতোয়ারা। আর এই উৎসবের জন্য তুলে দেওয়া হল এসএসসি-র চাকরির জন্য আন্দোলনরত শিক্ষকদের। কারণ, বিদেশিদের কাছে শিক্ষায় ও শিক্ষক নিয়োগের এই ঐতিহাসিক কলঙ্ক কী করে তুলে ধরা যায়? তাই সেটা আড়ালেই থাক। লেখক ঠিকই বলেছেন— এত উল্লাসের প্রয়োজন কী? প্রয়োজনটা বোধ হয় পরিকল্পিত। বিনোদন দিয়ে চেতনার কণ্ঠরোধ কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।

মধ্যরাতের বর্বরতার নজির গড়ল পুলিশ প্রশাসন। শেষ তিন দিন ২০১৪ সালে পরীক্ষা-উত্তীর্ণ টেট প্রার্থীরা আমরণ অনশনে বসেছিলেন, নিরস্ত্র, দুর্বল ও ফ্যাকাশে মুখের প্রার্থীদের পনেরো মিনিটের অপারেশনে টেনে-হিঁচড়ে পরিষ্কার করে দিল পুলিশ। অবশ্য, এর ঠিক দু’ঘণ্টা আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, ন্যায্য আন্দোলনকারীদের তিনি নাকি ভালবাসেন। তা হলে কি আন্দোলনকারীদের দাবি অন্যায্য ছিল? রাজ্যবাসী দেখলেন, প্রশাসনের নির্মমতার ছবি। মিড-ডে মিলে যেখানে শিশুগুলির পাতে সপ্তাহে একটা ডিমও জোটে না, সে রাজ্য খেলা, মেলা, মোচ্ছবের পিছনে অকাতরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কী করে? করার উদ্দেশ্যই বা কী? গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারের থেকে এ ধরনের আচরণ কখনওই কাম্য নয়। এর পরিবর্তন এখন একান্ত অপরিহার্য।

দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১

আরও পড়ুন
Advertisement