Manipur Violence

সম্পাদক সমীপেষু: শিকড় ভ্রাতৃত্বে

শ্রমজীবী মানুষ কখনও নিজে থেকে সংঘর্ষ ও হানাহানিতে লিপ্ত হয় না। তাদের সে ইচ্ছা, সময় বা সামর্থ্য কোনওটাই থাকে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৩ ০৪:১৩
An image of Manipur Violence

মণিপুরে সাম্প্রদায়িকতা, জাতি, বর্ণ, রাজনীতি ও ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ফাইল চিত্র।

মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘স্বার্থের সংঘাতে বিপন্ন’ (১৬-৫) মণিপুরে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রতিক হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এক তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা। সাম্প্রদায়িকতা, জাতি, বর্ণ, রাজনীতি ও ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই বৈষম্য ও বৈপরীত্যের ভিত্তিতে দুই গোষ্ঠীর মেরুকরণ ও সংঘাতের কারণ কিন্তু খুঁজতে হবে কোনও না কোনও সরকারি ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, যা দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব বা ভাঙন সৃষ্টি করে।

শ্রমজীবী মানুষ কখনও নিজে থেকে সংঘর্ষ ও হানাহানিতে লিপ্ত হয় না। তাদের সে ইচ্ছা, সময় বা সামর্থ্য কোনওটাই থাকে না। জীবিকা নির্বাহ করতেই তাদের দিন চলে যায়। পারস্পরিক সহানুভূতি, সহায়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধই সাধারণ মানুষের জীবনের ভিত্তি। যতই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক রেষারেষি ও হিংসা থাকুক না কেন, আপনা থেকে সেই হিংসা সার্বিক ও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক আকার ধারণ করে না।

Advertisement

‘মেরা হৌ চোঙবা’ বা ‘মেরা ওয়াউঙবা’ একটি মণিপুরি পরব। ‘মেরা’ হল মাস, ‘হৌ চোঙবা’ হল ভ্রাতৃত্ব আর ‘ওয়াউঙবা’ হল বাঁশের আগায় বাতি উত্তোলন। অর্থাৎ, বাঁশের আগায় বাতি উত্তোলন করে ভ্রাতৃত্ব উদ্‌যাপনের উৎসব। প্রতি বছর মেরা মাসে পাহাড়বাসী খ্রিস্টান কুকি ও উপত্যকাবাসী হিন্দু মেইতেইদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ব উদ্‌যাপনের উৎসব চলে এক মাস— অক্টোবর মাসের পূর্ণিমা থেকে নভেম্বর মাসের পূর্ণিমা পর্যন্ত।

উপত্যকার মেইতেইরা লম্বা বাঁশের আগায় বাতি জ্বালিয়ে পাহাড়বাসীদের যেন সঙ্কেত দেয়— হে পাহাড়বাসী ভাই ও বন্ধু, আমরা উপত্যকাবাসী ভাই ও বন্ধুরা তোমাদের জানাই প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমরা এখানে ভাল আছি। তোমরা সেখানে ভাল থেকো। এক মাস ধরে চলে পাহাড় ও উপত্যকাবাসীর উপহার বিনিময়, ভোজন ও বিনোদন। অক্টোবরের পূর্ণিমায় পাহাড়বাসীরা নেমে আসে উপত্যকাবাসী মেইতেইদের অতিথি হয়ে। সে দিন মেইতেইরা ফল ও গাঁদা ফুল দিয়ে তুলসীর পুজো করে।

এই রকম ঐতিহ্যমণ্ডিত ও প্রীতির সম্পর্ক কী করে ধ্বংসাত্মক রূপ নিতে পারে! বৈষম্যদুষ্ট, অসম, একপেশে, বঞ্চনাময় সরকারি নীতি— জমি কেনাবেচা, বন সংরক্ষণ ও বন-সম্পদের ব্যবহার, জনজাতি সংরক্ষণ, জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ— এই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কে বিভেদ তৈরি করে, যা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের রূপ নেয়, ও ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। মণিপুরের ঘটনা তারই পুনরাবৃত্তি।

সমরেশ কুমার দাস, জালুকি, নাগাল্যান্ড

নেতার ভূমিকা

মণিপুর যখন জ্বলছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তখন কর্নাটকে ভোট প্রচারে ‘জয় বজরংবলী’ বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন। ‘নেতা আসছেন’ (১১-৫) সম্পাদকীয়তে অত্যন্ত সঙ্গত ভাবেই প্রধানমন্ত্রীর এই অসংবেদনশীল আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। গণতন্ত্রে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে যাঁর হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিয়েছে, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সর্বপ্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত দেশের ও দেশের মানুষের সুরক্ষা। যখন দেশের মধ্যেই কোনও একটি রাজ্য জাতিদাঙ্গায় দীর্ণ, হাজার হাজার মানুষ রাজ্য ছেড়ে পালাচ্ছেন এবং বাড়ি থেকে পালিয়ে ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন, সেই সময়ে তাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে, শুধু রাজনৈতিক কুর্সি রক্ষার জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখা মানবিকতা বোধকেই প্রশ্ন করে।

রাজনৈতিক নেতাদের কাজের অগ্রাধিকার জনগণের অগ্রাধিকারের সঙ্গে মিলবে, এই আশা এখন না করাই ভাল। রাজনৈতিক নেতাদের প্রথম তাগিদ গদির উপর নিরঙ্কুশ অধিকার কায়েম রাখা। আর, নেতা এসে জনগণকে উদ্ধার করবেন— এ রকম চিন্তাভাবনা নিয়েই সাধারণ মানুষ থাকেন। তাই নেতাকে এক বার চোখের দেখা দেখতে মানুষ ভিড় করে। সম্পাদকীয়তে সঠিক ভাবেই নেতা-নেত্রীদের প্রতি জনগণের অতিরিক্ত মোহের কুপ্রভাবের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই অযৌক্তিক আবেগ ও মোহ ত্যাগ না করতে পারলে নেতারা তার ফয়দা তুলে নিজেদের কাজ হাসিল করবেন, এটাই স্বাভাবিক।

সুরজিত কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি

বিজেপির ব্যর্থতা

কিছু দিন আগে জনজাতি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে মণিপুর অশান্তিতে উত্তাল হয়েছিল। সেই সংঘর্ষের জেরে সরকারি মতে মৃত্যু ঘটেছে ৭৩ জনের, জখম ২৩১ জন। বেসরকারি মতে, সংখ্যাটা আরও বেশি। উল্লেখ্য, মণিপুরে ৩০টি উগ্রপন্থী সংগঠনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সংঘর্ষ-বিরতি চুক্তি হয়েছে। তবে সেই চুক্তি অনেকেই এখন আর মানছে না। গোয়েন্দা ও সরকারি সূত্রের খবর, ওই সব সংগঠনের বহু সদস্যই বর্তমানে শিবির ছেড়ে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। এমনও অভিযোগ উঠেছে যে, জনজাতিদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবি তুলে এদের প্রকারান্তরে ইন্ধন জোগাচ্ছেন বিজেপির ১০ জন বিধায়ক। যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ বলেছেন, এই দাবি সরকার কোনও অবস্থাতেই মানবে না, বরং উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে এগোবে কেন্দ্র ও রাজ্য। পৃথক রাজ্যের দাবিতে অটল থাকা ১০ জন বিধায়কের বিরুদ্ধে তা হলে সরকার ও দল কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে? মুখ্যমন্ত্রী এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন!

মেইতেইদের জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতির দাবির বিরোধিতা করে কুকি আদিবাসীদের ছাত্র সংগঠন। সংঘর্ষের মাত্রা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশও জারি করেছিল রাজ্য সরকার। যখন এমন বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে মণিপুর, সেই সময়ে কর্নাটকে ব্যস্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভোট প্রচারই তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ-হেন আচরণ শুধুমাত্র নিন্দনীয় নয়, তাঁদের চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়কও বটে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ঘটনার সাত দিন পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছেন যে, মণিপুরের অখণ্ডতা রক্ষায় কেন্দ্র সর্বতো ভাবে চেষ্টা চালাবে, যা নিতান্তই হাস্যকর। প্রাণ রক্ষার তাগিদে এ পর্যন্ত ৬৫০০ বাস্তুচ্যুত মানুষ মণিপুর ছেড়ে পাশের রাজ্য মিজোরামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। পাশাপাশি সংঘর্ষে জখম হওয়া বহু মানুষ মণিপুরে চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে মিজোরামে চিকিৎসা করাচ্ছেন।

পরিশেষে, মণিপুরের সাম্প্রতিক কালের অশান্তির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সারা দেশের অখণ্ডতা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপির চূড়ান্ত ব্যর্থতা ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবকে। স্বাধীন দেশের মানুষের জীবনে এ কী বিপর্যয়! নিজ রাজ্যে ঠাঁই নেই! সরকার মানুষকে ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি কর্নাটকে ভোট প্রচারে ব্যস্ত না থেকে, মণিপুরকে শান্ত করতে যথাযথ উদ্যোগ করতেন, এ ব্যাপারে আন্তরিক হতেন, তবে মণিপুরে অশান্তি তথা সংঘর্ষের চেহারা এতটা মারাত্মক আকার ধারণ করত না, এত মৃত্যুও হয়তো ঘটত না।

কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি

কোন মণিপুর?

‘স্বার্থের সংঘাতে বিপন্ন’ শীর্ষক প্রবন্ধে মণিপুর প্রসঙ্গে প্রবন্ধকার অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার কথা উল্লেখ করেছেন। চিত্রাঙ্গদা মণিপুর রাজার কন্যা অবশ্যই, কিন্তু সেই মণিপুর উত্তর-পূর্ব ভারতের বর্তমান মণিপুর নয়। সেটি ছিল অন্ধ্র-তামিলনাড়ুর উপকূল অঞ্চলে। রাজশেখর বসুর মহাভারত জানাচ্ছে— “উলুপীর কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন নানা তীর্থে পর্যটন করলেন, তার পর মহেন্দ্র পর্বত দেখে সমুদ্রতীর দিয়ে মণিপুর এলেন।”

উদয় চট্টোপাধ্যায়, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

আরও পড়ুন
Advertisement