Hospital

সম্পাদক সমীপেষু: একটি শয্যার জন্য

সরকারি হাসপাতালগুলিতে দালাল চক্র কত সক্রিয়, তা ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন। হাসপাতালে ‘শয্যা’ থাকে না তত ক্ষণই, যত ক্ষণ না এই দালাল চক্রের অর্থের দাবি মেটানো যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:০২

“শয্যা ‘মেলেনি’ তিন হাসপাতালে” (২৩-১১) সংবাদ প্রসঙ্গে এই পত্র। এই রাজ্যে ‘দুয়ারে সরকার’ চালু হলেও হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও শয্যা না পাওয়ার ট্র্যাডিশন আজও চলছে। সরকারি হাসপাতালগুলিতে দালাল চক্র কত সক্রিয়, তা ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন। হাসপাতালে ‘শয্যা’ থাকে না তত ক্ষণই, যত ক্ষণ না এই দালাল চক্রের অর্থের দাবি মেটানো যায়। মেটানো গেলেই আলাদিনের প্রদীপের মতো শয্যার আবির্ভাব ঘটে হাসপাতালে। বিশেষ করে কোভিডকালে এই দালাল চক্রকে রোগীর পরিবাররা ভগবানতুল্য মনে করেছেন এই ভেবে, যদি একটা শয্যা এরা জোগাড় করে দিতে পারে। আজিমগঞ্জের ৩২ বছরের যুবক সঞ্জীব মণ্ডলের হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরার কথা সংবাদমাধ্যমে চাউর হওয়ার পরে যদি শয্যার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে সেটা আগে কেন করা হয় না? তা হলে তো মানুষকে এত হয়রানির শিকার হতে হয় না। ‘স্বাস্থ্যসাথী’, ‘দুয়ারে সরকার’ অলিতে গলিতে বাজারের সর্বত্রই শোনা যায়। কিন্তু যখন দেখি গ্রামগঞ্জের এই সব খেটেখাওয়া মানুষ প্রাণপাত করছেন শুধু একটা শয্যার জন্য, তখন মনে হয় না এঁদের দুয়ারে সরকার পৌঁছতে পেরেছে বলে।

মিহির কানুনগো

Advertisement

কলকাতা-৮১

অদ্ভুত অভিযোগ!

(গত কালের পর) এ বার আমার নিজের কথা কিছু বলা জরুরি। এত বছরের লেখালিখিতে কুম্ভীলকবৃত্তির মতো গুরুতর অভিযোগের সম্মুখীন এই প্রথম বার হলাম, তাই এ বিষয়ে আমার তরফেও কিছু বলার থাকে। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক সচেতন শিল্পের কোনও না কোনও উদ্দেশ্য থাকে, লক্ষ্য থাকে, গন্তব্য থাকে। তাই কোনও একটি রচনার চরিত্রের নাম, শরীরের ভঙ্গি, প্রেমের আদল বা পেশার টানাপড়েনের চেয়েও অনেক বড় হয়ে ওঠে সেই রচনার মূল বক্তব্য, তার দর্শন, তার উপপাদ্য, তার গন্তব্য। নইলে কেবল গল্পের খাতিরে গল্প বলা ছাড়া সে আর কিছুই হয়ে ওঠে না। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে ধরলে আমার উপন্যাসটির সঙ্গে কণিষ্কবাবুর লেখার বিস্তর ফারাক ও অমিল। মিলের সঙ্গে অমিলের উল্লেখও তাই জরুরি। আশরফ, মোহিনী, তাঁদের লুপ্তপ্রায় শিল্প ও টানাপড়েনের জীবনের মাধ্যমে আমার উপন্যাসটি এক বিশেষ ও বৃহত্তর দর্শনে, তত্ত্বে উপনীত হতে চায়, যা তার চরিত্রায়ণ, আঙ্গিক ও কাহিনিরূপের চেয়ে বহুগুণে বিস্তৃত। সে উত্তরণ শেষে ঘটেছে কি না, তা বলবেন পাঠক ও সময় স্বয়ং। কিন্তু সেই চেষ্টা যে আমার লেখায় বিদ্যমান, সে কথা নিন্দুকের পক্ষে অস্বীকার করাও দুষ্কর। আশা করি আমার লেখায় সেই প্রয়াসের চিহ্ন কণিষ্কবাবুরও নজর এড়ায়নি। এই একটি জায়গায় দু’টি লেখার কিন্তু ভারী অমিল। কণিষ্কবাবুর ছোটগল্পটির রচনাশৈলী, ভাষাভঙ্গি, প্রকাশরূপ, সমস্ত কিছুই আমার উপন্যাসের চেয়ে বিস্তর আলাদা। তবে লক্ষণীয় ভাবে আলাদা এই লেখার গন্তব্য। অর্থাৎ, এই দুই লেখার হয়ে ওঠার কারণ, শিল্পের ক্ষেত্রে যার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। তাই বলতে দ্বিধা করব না, এমনকি আমি যদি উল্লিখিত ছোটগল্পটি আগেভাগে পড়েও থাকতাম, তা হলেও এই উপন্যাস রচনা থেকে বিরত হতাম না। কেননা, ভারী সচেতন ভাবেই এই উপন্যাস তাঁর গল্পের থেকে আমূল আলাদা। তবে হ্যাঁ, জানা থাকলে কিছু বৈশিষ্ট্য বা নাম হয়তো পরিবর্তন করতাম, তাতে আজকের এই দুর্ভাগ্যজনক অভিযোগ অন্তত এড়ানো যেত।

যে মানুষ আপেল চুরি করে, সে কখনও আপেলের চাষ করে না। কেননা চুরির প্রধান কারণই হল, বিনা পরিশ্রমে এবং অল্প সময়ে লাভবান হওয়ার প্রলোভন। আমার উপন্যাসটিতে মেধা বা মননের প্রতিফলন কত দূর ঘটেছে জানা নেই, কিন্তু এই একটি লেখা গড়ে তুলতে যে পরিমাণ ভাবনা, শ্রম ও অভিজ্ঞতা ব্যয় করতে হয়েছে, তা চৌর্যবৃত্তির প্রধান কারণের সঙ্গে বড়ই অসঙ্গতিপূর্ণ। উপন্যাস হওয়ার স্বাভাবিক কারণেই, চরিত্রের যে খনন, যে বুনন, যে গঠন, তাদের পারিপার্শ্বিক এবং অতীতের সংমিশ্রণে গড়ে উঠতে চাওয়া যে আবহ, তার যে গভীরতা ও অন্তরঙ্গতা, এই সমস্ত কিছুর সৃষ্টিতে বহু দিনের সময় ও পরিশ্রমকে লগ্নি করতে হয়। আমাকেও হয়েছে। কেবলমাত্র কিছু নাম ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্য চুরি করলেই দীর্ঘকায় সেই লেখা রচনা করা সম্ভব হয় না। এমনকি তার অধিকারীও হওয়া যায় না। লেখক মাত্রেই তা জানেন।

কিন্তু আমার উপন্যাসের ভাবনার বীজ একটি লেখা থেকে গৃহীত। “জাদুকরদেরও অবসর হয় এক দিন। তখন তারা লুকিয়ে থাকে চিলেকোঠায়। লুকিয়ে থাকে আর বিড়বিড় করে। লুকিয়ে থাকে আর নীচে বয়ে চলা ছোট পাড়াটাকে দ্যাখে। অবসরপ্রাপ্ত জাদুকরেরা আস্তে আস্তে একা হয়ে যায়, নিজেদেরই কারণে। রেশন দোকানে গিয়ে তারা ঝোলা থেকে কার্ডের বদলে খরগোশ বার করে বসে। সকলে আড়চোখে তাকায়, মুখ টিপে হাসে। ডাক্তারবাবুর হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নেওয়ার পর তাঁরই হাতঘড়ি তাঁকে ফেরত দেয় ফি হিসেবে। অবাক হওয়ার বদলে ডাক্তারবাবু বিরক্ত হন। দূর সম্পর্কের ভাইঝির জন্মদিনে কোত্থেকে চলে আসে ঘরভর্তি পায়রা, সে এক যাচ্ছেতাই কাণ্ড। অথচ আর কয়েক বছর আগে এ সব দেখেই লোকে হাততালি দিত বার বার। কিছু মেলাতে পারে না বুড়ো হয়ে যাওয়া বাতিল জাদুকরেরা। তারা চিলেকোঠায় একলা হয়ে যেতে থাকে কেবল। অবশ্য একেবারে একলা নয়। মাঝেমধ্যে কিছু পায়রা আর খরগোশ এসে দেখা করে যায়। তাদেরও রেশন কার্ড হারিয়ে গেছে।”

সসঙ্কোচে জানাই, কবিতাটি আমারই রচিত। রচনাকাল ২০১৫। এখনও পর্যন্ত অগ্রন্থিত হলেও, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আমার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে প্রথম বার লেখাটি পোস্ট করি। এর পরেও এক-দু’বার করেছি। কিন্তু বিষয় সেটি নয়। বিষয় হল, কবিতা হিসাবে এই লেখাটি রচিত হওয়ার পর বারে বারে এর মধ্যে একটি পূর্ণ উপন্যাসের ভাবনাকে আবিষ্কার করেছি এবং দীর্ঘদিন ধরে তাকে লালন করেছি। শেষে এই কবিতার জাদুকরই পাঁচ বছর পর আমার উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র মোহিনী হয়ে ওঠে, এই কবিতার চিলেকোঠাই হয়ে ওঠে উপন্যাসের মোহিনীরও বাসস্থল।

এমনকি এই কবিতায় বর্ণিত ঘটনাবলির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ‘খরগোশ আর মারুবেহাগ’ উপন্যাসের ১২ সংখ্যক পরিচ্ছেদে। আশা করি কণিষ্কবাবুর তা মনে থাকবে। এই কবিতায় বর্ণিত জাদুকরকে কেন্দ্র করে ভাবনাটা যখন পাক খেতে থাকে মাথায়, একে একে অন্যান্য চরিত্রেরা এসে জুটতে শুরু করে। এই কবিতার পটভূমি ছাড়িয়ে অবসরপ্রাপ্ত, বাতিল, বুড়ো জাদুকর খুঁজে পায় তার উপন্যাসের সঙ্গীদের, তার আখ্যানের বিস্তারকে। সুতরাং, চুরি যদি করেই থাকি, নিজের ভাবের ঘরেই করেছি। অন্যের ভাঁড়ারে হাত বাড়ানোর রুচি বা প্রয়োজন, কোনওটাই হয়নি।

পরিশেষে বলি, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আমার ফেসবুক পেজ থেকে এই কবিতাটি স্বয়ং কণিষ্কবাবুও পড়েছিলেন এবং ফেসবুকে সে লেখার নীচে তাঁর পছন্দচিহ্ন আজও বিদ্যমান। কিন্তু কেবলমাত্র এই লেখাতে তাঁর পছন্দচিহ্নের উপস্থিতির কারণে কি আমি এমনটা কল্পনা করতে চাইব যে, ২০১৬-য় পঠিত এই শীর্ণকায় কবিতা থেকেই কণিষ্কবাবু তাঁর দু’বছর পরের রচিত ছোটগল্পের অবসরপ্রাপ্ত, বাতিল জাদুকরের চরিত্রটি আহরণ করেছেন? বা এই কবিতা পড়ার পরই তিনি পরিকল্পনা করেছেন এমন একটি গল্পের, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র ঠিক এই কবিতায় বর্ণিত চরিত্রেরই মতো? না, আমি তা ভাবব না। কেননা কোনও লেখকের কল্পনাকে এতখানি সঙ্কীর্ণ করে দেখার মনোবৃত্তি আমার নেই, যেন কখনও না হয়। সমসময়ের অধিবাসী বহু মানুষ একই ভাবনায় জারিত হবেন, এ আমার কাছে নেহাত স্বাভাবিক। সেখানে মাত্র দু’জনের ভাবনার অংশবিশেষ মিলে গেলে তাকে চৌর্যবৃত্তি বলার স্পর্ধা আমার নেই।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই উত্তর দীর্ঘায়িত হল, সে কারণে মার্জনাপ্রার্থী।

শ্রীজাত

কলকাতা-৩১

আরও পড়ুন
Advertisement