বছরের শেষে স্কুল খুলছে, শুরু হল নবম থেকে দ্বাদশের ক্লাস। অন্যান্য শ্রেণির অবস্থা আগের মতোই। আবার কলেজের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, কিছু কিছু কলেজে অনেক সিমেস্টারের ক্লাস হচ্ছে না, অনেক কলেজে ক্লাস হলেও নিয়মিত হচ্ছে না। যেমন— রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ পঞ্চম সিমেস্টারের ক্লাস হচ্ছে, প্রথম, দ্বিতীয় সিমেস্টারের ক্লাস এখনও অনলাইন। অথচ, অধিকাংশ কলেজ পড়ুয়াদের কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এমনকি কলেজগুলো নিজে থেকেও ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। তবুও ১৬ নভেম্বর থেকে কলেজ খুলল শুধু নামে!
আমরা বনগাঁ লোকালের ভিড় দেখছি প্রতি দিন, শপিং মল, রেস্তরাঁতে ভিড় জমতে দেখছি। কলকাতার বুর্জ খলিফা, বারাসতের কালীপুজো বা চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীপুজো থেকে শুরু করে দিঘায় পর্যটকদের ভিড়ও দেখছি। মদের দোকানে লাইন দেখছি। নির্বাচনের পর উপনির্বাচনে সভা-সমাবেশ দেখেছি। পুর নির্বাচনও আসন্নপ্রায়। কিন্তু স্কুল-কলেজ খুলল ‘নমো নমো’ করে। এই ভাবে আর কত দিন? সবই যখন স্বাভাবিকতায় ফিরছে, তখন স্কুল-কলেজও খুলুক স্কুল-কলেজের মতো করে।
দুর্জয় বাড়ৈ
অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
অদ্ভুত অভিযোগ!
[গত কালের পর] আমার বিরুদ্ধে অভিযোগে কণিষ্ক ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় যুক্তি, তাঁর গল্প ও আমার উপন্যাসের চরিত্রায়ণ এক। এক জন জাদুকর ও এক জন সঙ্গীতশিল্পী। হ্যাঁ, মিলটি অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। আলোচ্য দুই রচনার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের পেশাগত পরিচয়ের মিল অনস্বীকার্য। এক জন জাদুকর, আর এক জন সঙ্গীতশিল্পী। যদিও দ্বিতীয় চরিত্রের ক্ষেত্রে সঙ্গীতের ধরন একেবারেই আলাদা, কণিষ্কবাবুর চরিত্রের পেশা মাচায় কণ্ঠ অনুকরণ করে গাওয়া, আমার চরিত্রটির পেশা বিয়ের নহবতে সানাই বাজানো। যদিও নহবতের শিল্পীদের জীবন বা টানাপড়েন আমার নিত্যযাপনের মধ্যে আসেনি, যেমন আসেনি এই উপন্যাসে বর্ণিত গ্রামীণ জীবনধারা, কিন্তু তা বাদে ‘আশরফ’ নামক সানাইবাদক চরিত্রটির যে সাঙ্গীতিক চর্যা, শিক্ষা, সাধনা ও অনুশীলন, তা আমার চোখে-দেখা বিষয়। হয়তো এই কারণেই জাদুকরের পাশাপাশি সঙ্গীতশিল্পীকে বেছে নিয়েছিলাম চরিত্র হিসাবে, যাতে এক জনের পরিক্রমা অজানা হলেও, আর এক জনের চলন অন্তত জানা থাকে।
তাঁর তৃতীয় যুক্তি “দুই ক্ষেত্রেই জাদুকর আগে নিয়মিত কাজ পেতেন এবং জাদুকে কেবল মনোরঞ্জনের বিষয় নয়, একটি শিল্প বা আর্ট হিসেবে দেখতেন।” দু’টি লেখার উপজীব্যই যে হেতু মৃতপ্রায় শিল্প বা ‘ডায়িং আর্ট’, তখন এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। আগে কাজ পেতেন, এখন তা পান না বলেই তো শিল্পটি মৃতপ্রায়। শিল্পী তো নিজের কাজকে মনোরঞ্জন বলে না দেখে শিল্প বলেই দেখবেন। এই যুক্তি খণ্ডন করার প্রয়োজন দেখি না। এ তো স্বতঃসিদ্ধ।
এ বার চতুর্থ যুক্তি, জাদুকরের নামকরণ। কণিষ্কবাবুর জাদুকরের নাম ‘হর’, যা শিবের অপর নাম, আমার চরিত্রের নাম ‘মোহিনী’ যা, কণিষ্কবাবু মনে করিয়ে দেন, নারায়ণের অপর নাম। সেই অর্থে বহু ভারতীয় হিন্দু নারী-পুরুষের নামকরণই বিভিন্ন দেবদেবীর নামানুসারে হয়ে থাকে, তা হলে কি ধরে নেব, তাঁরা নামের ক্ষেত্রে পারস্পরিক চৌর্যবৃত্তির অনুসারী? তিনি এই দুই চরিত্রের চেহারাগত সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন এই বলে যে, আমার সৃষ্ট চরিত্রটি চেহারায় ‘লম্বাটে, রোগাটে, সপাট, টানটান’ এবং তাঁর সৃষ্ট চরিত্রটি ‘গেঁজেলশুখা’। এই দুই যে এক, তা আমার ধারণা ছিল না। গঞ্জিকাসক্ত শুষ্কদেহীর সঙ্গে দীর্ঘকায়, শীর্ণ ও ঋজু শরীরকাঠামোর ঠিক কী মিল, তা আমার বোধগম্য হল না। নেহাতই সাদৃশ্য খুঁজে বার করার জন্য এই কষ্টকল্পনা কোনও লেখককে মানায় না। তিনি অভিযোগ করেছেন, তাঁর জাদুকরের পোশাকি নাম ‘হ্যারি দ্য ম্যাজিশিয়ান’, আমার উপন্যাসের জাদুকরের শিক্ষাগুরু নিজের নাম রাখেন ‘ব্রিগেঞ্জা দ্য ব্রিলিয়ান্ট’। জাদুকরদের নাম যুগে যুগে এমনই হয়ে আসছে— অনেকটা কদমগাছে কদমফুল ফোটার মতোই স্বাভাবিক।
প্রসঙ্গত, বিমল কর মহাশয় আমাদের কৈশোরে এক অসাধারণ চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন, যিনি এক জাদুকর, চেহারায় রোগাসোগা ও টিকলো নাকের অধিকারী: ‘কিকিরা দ্য গ্রেট’। সেই স্বল্পভাষী, চিন্তাশীল, অবসরপ্রাপ্ত জাদুকর কিকিরা আমার অবচেতনে বিরাজ করে থাকতেও পারেন, কণিষ্কবাবুর ‘হ্যারি দ্য ম্যাজিশিয়ান’ কখনওই নয়।
পঞ্চম যুক্তিতে কণিষ্কবাবু লিখছেন, তাঁর গল্পের জাদুকর প্রেমে পড়েছিলেন নিজের গুরুপত্নীর, আমার উপন্যাস সানাইবাদক প্রেমে পড়েন নিজের গুরুকন্যার। উপন্যাসে বা চলচ্চিত্রে এও আজ আর কিছু মৌলিক বিষয় নয়। কণিষ্কবাবুর খেয়াল থাকবে হয়তো, বারে বারে সেখানে অপরাধ বা ‘গুনাহ’র কথা ওঠে, ওঠে নিষিদ্ধের প্রতি আসক্তির কথা। সেই সূত্রে গুরুকন্যার প্রতি আশরফের প্রেমের কথাও আসে। উপন্যাসের গতি অনুযায়ী নিষিদ্ধের এই নাটকীয়তাই স্বাভাবিক ছিল।
সপ্তম যুক্তিতে কণিষ্কবাবু বলছেন, দুই সঙ্গীতশিল্পীর মিলের কথা, যদিও আমার মতে, এই দুই চরিত্র সঙ্গীতেরই দুই দূরবর্তী অবস্থানে বিদ্যমান, এ ব্যতীত কোনও মিল কোথাও নেই। দুই আলোচ্য রচনার প্রধান উপজীব্য বা ভিত্তি যদি মৃতপ্রায় শিল্প ও লুপ্তপ্রায় শিল্পীরা হয়ে থাকেন, তা হলে এমনটাই তো হওয়ার কথা। নব্য প্রযুক্তির বিরুদ্ধে অসমযুদ্ধে হেরে গিয়ে শিল্পের অকৃত্রিম আঙ্গিকের আত্মসমর্পণ, এ কি আদৌ নতুন কিছু? আমার উপন্যাসটির গোড়াতেই দেখানো হয়েছে এমন এক চরিত্র, মঞ্জীর, যে তার তথ্যচিত্রের জন্য ঠিক সেই সমস্ত শিল্পীকেই খুঁজছে, যাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন, প্রযুক্তির সঙ্গে, সমসময়ের সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে উঠছেন না। অতএব জাদুকর হোক বা সঙ্গীতশিল্পী, প্রযুক্তির কাছে নত হয়ে যাওয়া মানুষই তো আমার লেখার চরিত্র হয়ে ওঠার কথা। ১৯৮৮-তে নির্মিত জুসেপ্পে তোর্নাতোরে-র সিনেমা পারাদিসো নামক বহুলচর্চিত চলচ্চিত্রটিতে আলফ্রেডো আত্মহত্যা করেন— যিনি এক সময়ে পেশায় ছিলেন ছোট্ট প্রেক্ষাগৃহের প্রক্ষেপণের দায়িত্বে। এক বিত্তবান ব্যক্তি অনেক টাকা দিয়ে প্রেক্ষাগৃহটি কিনে নেন এবং সেখানে অত্যাধুনিক পার্কিং লট তৈরি করেন। পুঁজির সামনে, প্রযুক্তির সামনে, ক্ষমতায়নের সামনে শিল্পের এই পরাজয় কাহিনি, অতএব, একেবারেই নতুন কিছু নয়। অত দূরে ও অত আগে না গিয়েও বলতে পারি, ২০১৬ সালে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সিনেমাওয়ালা চলচ্চিত্রটির কথা, যেখানে এক দিকে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা প্রেক্ষাগৃহের মালিকের বিপন্নতা, অবসাদ এবং অন্য দিকে তারই পুত্রের ডিভিডি শো-এর রমরমে কাঁচা ব্যবসা। সুতরাং, কণিষ্কবাবু যে যে জায়গা থেকে নিজের মৌলিকত্বের দাবি রাখছেন এবং আমাকে অনুকরণ-দোষে অভিযুক্ত করছেন, তার একটিও মৌলিক নয়, সব ক’টিই বহু আগে শিল্পের নানা শাখায় প্রদর্শিত।
এর পর, অষ্টম যুক্তি হিসাবে কণিষ্কবাবু যা বলেছেন, তাকে কষ্টকল্পনা এবং হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। তাঁর বক্তব্য, “মাচার কণ্ঠী অনঙ্গ দাস অন্তরে নারী শরীরে পুরুষ। যৌন পরিচয়ে সমপ্রেমী। শ্রীজাতর চরিত্রের সমপ্রেমী বৈশিষ্ট্য নিয়ে গিয়েছেন মঞ্জীর চরিত্র।” নিজের অভিযোগ প্রমাণে একান্তই মরিয়া না হলে কোনও বিবেচক ব্যক্তির পক্ষে এই উপপাদ্য রচনা অসম্ভব। সমকাম কোনও অপার্থিব বা অলৌকিক বিষয় নয়, যার জন্য এতখানি পরিশ্রম করতে হবে, শারীরিক ভাবে পুরুষ চরিত্রের মননের নারীময়তা ভেঙে নিয়ে গড়ে তুলতে হবে সমকামী নারীচরিত্র, যে নাকি উপন্যাসের সূত্রধর। গদ্যকার হিসাবে আমার পথচলা সবে শুরু, কিন্তু নিজে ভাবার অভ্যেস বা কল্পনাশক্তি একেবারে নিঃশেষিত হয়ে যায়নি, যাতে এমন বিচিত্র কাণ্ড ঘটাতে হতে পারে।
কণিষ্কবাবু বলছেন, “ম্যাজিক ও সময় সম্পর্কে বক্তব্যেও আশ্চর্য মিল।” আমার উপন্যাসে আশরফ বলেন, “জানো মোহিনী, সময় নিজেও একটা ম্যাজিক। অনেক সময় একটা মুহূর্ত এমন ভাবে কাটে, যেন বছর পেরোচ্ছি। আবার অনেক সময়ে দশ বছরেও সময় এগোতে চায় না।” এই বক্তব্যের সঙ্গে কণিষ্কবাবু তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের বক্তব্যের মিল পেয়ে থাকলে আমি খুশি। কেননা সময়কে এ ভাবে দেখতে চায় শিল্পই একমাত্র। আন্দ্রেই তারকোভস্কির ডায়েরি সঙ্কলন টাইম উইদিন টাইম-এ সময় সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য মনে আছে নিশ্চয়। এত তত্ত্ব, এত ভাবনার বীজ হিসাবে আমি কেবল ২০১৮ সালে প্রকাশিত কণিষ্কবাবুর ছোটগল্পটিকেই পেয়েছিলাম, এ দাবি ভারী আবদারে কিন্তু। কণিষ্কবাবুর নয়টি যুক্তির উত্তরে আমার বক্তব্য পেশ করলাম।
(বক্তব্যের শেষ অংশ কালকের ‘সম্পাদক সমীপেষু’ বিভাগে)
শ্রীজাত
কলকাতা-৩১