যশোধরা রায়চৌধুরী তাঁর “অথ ‘স্ত্রীচরিত্র-বর্জিত’” শীর্ষক প্রবন্ধে দুঃখের সঙ্গে বলেছেন, যে সামান্য ক’টি কিশোরী চরিত্র আছে, সেগুলোও কোনও লেখক নয়, লেখিকার কলম থেকে বেরিয়েছে। এবং সে জন্য উনি পুরুষতন্ত্রকেই পরোক্ষে দায়ী করেছেন।
বোঝাই যাচ্ছে, আগে সাজা ঘোষণা হয়েছে, তার পর সাজার পক্ষে যুক্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই ধরনের বিচারের ক্ষেত্রে, বেশির ভাগ সময় নারী-পুরুষ সম্পর্কিত জীববিদ্যাকে প্রায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়। জীববিদ্যায় নারী-পুরুষ কেউ কারও থেকে বড় নয়, ছোট নয়, এমনকি সমানও নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি সত্তা। সেই ভিন্নতা অস্বীকার করে গল্প লেখা কিন্তু বড্ড কঠিন। কারণ, পুরুষ লেখক যখন গল্প লেখেন ছোটদের জন্য, তিনি নিজের বা বন্ধুদের ছোটবেলা, নিজেদের ভাবনা, ডানপিটেমি, নিজের বয়ঃসন্ধির অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করেই গল্প লেখেন বেশির ভাগ সময়। কিন্তু একটা ছোট মেয়ে কী ভাবে ভাবে, কী ভাবে বয়ঃসন্ধিতে সে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চায়, সেটা হয়তো তাঁর জন্য ভাবা কঠিন। বেশির ভাগ লেখকই সেটাতে স্বচ্ছন্দ নন বলেই কিশোরীকে মূল চরিত্র করে লেখেননি। এ ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক বলে লেখেননি— সেটা খুব একপেশে সিদ্ধান্ত।
পুরুষতন্ত্র, নারীবাদ ইত্যাদির দ্বন্দ্বের মধ্যে জীববিদ্যার কথা কেন ভুললে চলবে না, তা একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একটি ছেলে ও মেয়ের ক্রোমোজ়োমের ফারাক আছে— এটা সবাই জানি। কিন্তু ছেলে ও মেয়েদের মেজাজ, ভাবনা, যৌনতা— সবই আলাদা। এগুলো কি আমরা ধরব না? মেঘলা দিনে মেয়েদের মনখারাপ বেশি দেখা যায় কেন? অনুমান, ইস্ট্রোজেনের জন্য মেজাজ-নিয়ন্ত্রক সেরাটোনিন তৈরিতে প্রভাব পড়ে। সেই ইস্ট্রোজেনের প্রভাব ছেলেদের মধ্যে কম। এ বার এই কিশোরীবেলায় মন খারাপের সূক্ষ্মতা এক জন লেখিকার কাছে কি অনায়াসেই ধরা দেবে না এক জন লেখকের তুলনায়? নারী-পুরুষ যে বায়োলজিক্যালি ভিন্ন, তাদের চিন্তাভাবনাও ভিন্ন, এ ব্যাপারটা অস্বীকার করে কেউ লেখার চেষ্টা করলে তা আরোপিত লাগবে, আর সাহিত্য হিসাবেও হয়তো তা সফল হবে না।
শেষে বলব, আমাদের শিশু বা কিশোরসাহিত্যে নারীচরিত্র কম, তার কারণ লেখিকাই কম। নবনীতা দেব সেন নিজের আর দুই মেয়ের ছোটবেলার কাণ্ডকারখানা নিয়ে কত চমৎকার সব গল্প লিখেছেন। এ রকম উদাহরণ মাথায় রেখে বর্তমানের লেখিকারাও যদি কিশোরী চরিত্র তৈরি করেন, তা হলেই অনেক চরিত্র সৃষ্টি হতে পারে। তাতে জোর করে কিছু আরোপ করতে হবে না।
নির্মাল্য দাশগুপ্ত
স্যান ডিয়েগো, আমেরিকা
সমানে-সমানে
“অথ ‘স্ত্রীচরিত্র-বর্জিত’” পড়ে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে এক রকম অসুবিধেই হল। যশোধরা রায়চৌধুরী লিখেছেন, ছোটবেলাতে তাঁর খটকা লাগত নলিনী দাশের ‘গণ্ডালু’ ছাড়া অন্যান্য ছোটদের গল্পে মেয়েরা অনুপস্থিত কেন, তা ভেবে। এবং এখন তাঁর সাসপিশাস লাগে এটা ভেবে যে, “এই যে, এত এত ‘টেক্সট’ আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের হাত থেকে এল আমাদের হাতে... এর ভিতরে কী কী যেন নেই...— নারী-চরিত্র! মেয়েরা নেই সেখানে!”
আমার ছোটবেলা পুরোটাই কেটেছে আনন্দমেলা পত্রিকার সঙ্গে। সেই পত্রিকার নিয়মিত পাঠক হিসাবে কখনও এটা ভাবার সুযোগ পাইনি যে, ছোটদের সাহিত্যে আদৌ মেয়েদের কোনও অনুপস্থিতি রয়েছে বলে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি, তরুণ মজুমদারের চিত্রনাট্য আর বিমল দাসের আঁকা ছবিতে সমৃদ্ধ ধারাবাহিক চিত্রকাহিনি ‘সদাশিব’ বার হত তখন আনন্দমেলা-য়। সেখানে কিশোর সদাশিবের সঙ্গে মরাঠি বালিকা কুঙ্কুর নিরুচ্চার প্রেমের সম্পর্ক দোলা দিয়ে যেত মনে। পুজোসংখ্যা আনন্দমেলা-য় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘ইতি তোমার মা’ পড়ে মনে যে অনুভূতির জন্ম হয়েছিল, তা অতুলনীয়। ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র টিমে তিনটি ছেলের সঙ্গে কিন্তু বরাবর দু’টি মেয়েও থাকত। ঋজুদার বেশ কিছু অ্যাডভেঞ্চারে সঙ্গী হয়েছিল তরুণী তিতির, আর তার ভূমিকা কারও ‘গার্লফ্রেন্ড’ হিসাবে ছিল না। তার বন্দুকের নিশানা ছিল ঋজুদার থেকেও ভাল। সেই দক্ষতাতেই সে জায়গা পেয়েছিল অভিযানগুলোয়।
ফেলুদা-শঙ্কু-কাকাবাবু-ঘনাদার অভিযানে কেন মেয়েরা সরাসরি ভাগ নিচ্ছে না, সেই প্রশ্ন কখনও মনে আসেনি। ঠিক যে ভাবে মনে কখনও প্রশ্ন আসেনি যে, টিনটিন-অ্যাসটেরিক্স-শার্লক হোমস বা ইন্ডিয়ানা জোন্সের অ্যাডভেঞ্চারে কখনও মেয়েরা সে ভাবে সঙ্গী হচ্ছে না কেন। সত্যজিৎ রায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বা প্রেমেন্দ্র মিত্র আজ যে কারণে ‘দোষী’ সাব্যস্ত হচ্ছেন, সেই একই দোষে কোনান ডয়েল, হার্জে বা স্পিলবার্গরা কেন ছাড় পাচ্ছেন, জানতে কৌতূহল হয়। আগাথা ক্রিস্টির জনপ্রিয় পুরুষ গোয়েন্দা পোয়ারো দুনিয়া চষে বেড়ান। এ দিকে তাঁরই সৃষ্ট মিস মার্পলকে বন্দি থাকতে হয় ছোট্ট গণ্ডিতে— এই বা কেমন অবিচার!
আমার ছোটবেলায় আনন্দমেলা-র সঙ্গেই ছিল মায়ের কিনে দেওয়া বাংলার রূপকথার দুর্দান্ত সব বই। এবং সঙ্গে বাংলা অনুবাদে বাকি সারা পৃথিবীর রূপকথা তো ছিলই। সে সব রূপকথার কথা ছেড়েই দিচ্ছি, আপাতত পশ্চিম এশিয়ার ‘আরব্য রজনী’র কথা বলি। এই আখ্যানের লীলা মজুমদারকৃত ছোটদের সংস্করণ শেষ করেছিলাম প্রায় এক নিশ্বাসে। রুদ্ধশ্বাসে দেখেছিলাম, অত্যাচারী সুলতান শাহরিয়রকে শায়েস্তা করছেন কোনও পুরুষ নয়— এক নারীই!
সে সময় ভারতবর্ষের ইতিহাস-পুরাণ-সাহিত্য-মনীষী জীবনী আর সংস্কৃতির ছোঁয়া পেতাম ‘অমর চিত্র কথা’ থেকে। তার পাতাজোড়া ইলাস্ট্রেশনে পুরুষ আর নারীদের উপস্থিতি একেবারে সমান। সেখানে রাণা প্রতাপকে নিয়ে যেমন কমিকস ছাপা হত, তেমনই কমিকস ছাপা হত ঝাঁসির রানিকে নিয়েও। রাজা হরিশ্চন্দ্রের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে বার হত সুলতানা রাজিয়ার কীর্তিকাহিনিও।
ভাস্কর রায়
কলকাতা-৭৭
মিতিন মাসি
যশোধরা রায়চৌধুরী বাংলায় ছোটদের সাহিত্যে হাতেগোনা যে নারী-গোয়েন্দারা এসেছে এবং পাঠক-পাঠিকাদের হৃদয় জয় করেছে, তাঁদের কথা বলতে গিয়ে, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র মিতিন মাসির কথা উল্লেখ করেছেন। নির্দ্বিধায় বলা যায় মিতিন মাসি, বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত যত গোয়েন্দা চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন লেখক-লেখিকারা, তাদের মধ্যে অন্যতম। বহু বাঙালি পাঠক-পাঠিকার মতো আমারও অত্যন্ত প্রিয় মিতিন মাসি। সেই কথা এক বার বইমেলাতে সুচিত্রা ভট্টাচার্যকে সামনা-সামনি পেয়ে বলাতে, বইতে সই করতে করতেই মুখ তুলে একটু হেসেছিলেন প্রখ্যাত লেখিকা।
দুঃখ একটাই। বড্ড তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন মিতিন মাসির স্রষ্টা। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি বাংলা সাহিত্যের।
সৌরীশ মিশ্র
কলকাতা-৯১
স্বাবলম্বী সাহিত্য
বাস্তবিকই প্রথিতযশা লেখক-লেখিকারা স্ত্রীচরিত্র বর্জন করে কিশোরসাহিত্যকে অপূর্ণ রেখেছেন। তবে এও ঠিক, তখনকার দিনে মেয়েদের গৃহবন্দি হয়ে থাকার যে বিধিনিষেধ এবং অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার চালচিত্র লেখক-লেখিকার কলমে ফুটে উঠেছে। কিন্তু মনে রাখা উচিত, কালোত্তীর্ণ লেখাই সবচেয়ে সার্থকতা লাভ করে। সে দিক থেকে বিদেশি কিশোরসাহিত্য অনেক এগিয়ে।
কিন্তু পরবর্তী কালে স্ত্রীচরিত্র নিয়ে অনেক কাহিনি সৃষ্টি হয়েছে। স্ত্রীচরিত্র বর্জিত একটা লেখাও এখন পাওয়া যাবে না। এটা এক প্রকার বিপ্লব বলা যেতে পারে। আজকের দিনে ছোটদের সাহিত্য নিঃসন্দেহে যথেষ্ট স্বাবলম্বী ও শক্তিশালী
বিবেকানন্দ চৌধুরী
কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান