West Bengal

সম্পাদক সমীপেষু: মেকি আস্ফালন

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে দলের শহুরে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে, তাঁরা ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪ ০৫:৩৪

—ফাইল চিত্র।

ঋতজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারসাম্যের রাজনীতি’ (৩-৭) প্রবন্ধটি এক কথায় অনবদ্য। প্রবন্ধকার সাম্প্রতিক হকার উচ্ছেদ প্রসঙ্গে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তার পরেও কয়েকটি বিষয় না বললেই নয়। যেমন, ‘বেআইনি দখলদার’ কথাটি যদি শুধুমাত্র হকারদের বেআইনি দখল সম্পর্কিত হয়, তা হলে আসল সত্যিকে আড়াল করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে দলের শহুরে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে, তাঁরা ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। মূলত তাঁদের মদতেই সরকারি জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে এবং পুরসভা এলাকাগুলোয় ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে শহুরে ও শিক্ষিত মধ্য ও উচ্চবিত্ত সমাজে তৃণমূলের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ধস নেমেছে। প্রবন্ধকার ঠিক কথাই বলেছেন, প্রথম দিকে তৃণমূল দলটা মূলত শহর, বিশেষত কলকাতা-কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বিভিন্ন আন্দোলনে তৃণমূলের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে তারা ক্রমশ গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক হকার উচ্ছেদের পদক্ষেপ শহরাঞ্চলে তাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারেরই প্রচেষ্টা। এ দিকে, গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতিগুলি দুর্নীতির আঁতুড়ঘর হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। বাংলার গ্রামাঞ্চলের নয়ানজুলি ভরাট করে দোতলা দোকানঘর, জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ হয়েছে। পুলিশ, বিডিও বা প্রশাসন এই বিষয়ে কিছুই জানত না? শহরেও বেআইনি ফুটপাত, রাস্তা দখল, পুকুর ভরাট করে নির্মাণ হচ্ছে। চার দিকেই চলছে দুর্নীতির প্রতিযোগিতা। খোঁজ করলেই দেখা যাচ্ছে, সমস্ত বেআইনি নির্মাণের তির শাসক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। সরকার যতই আস্ফালন করুক, রাজ্যে বেআইনি দখলদারদের শেষ পর্যন্ত উচ্ছেদ করা হবে না বলে বিরোধীরা যে দাবি করছেন, তা কি অমূলক? তা ছাড়া উচ্ছেদের ক্ষেত্রেও স্থান ও ধর্ম নির্বিশেষে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে। এই দুর্নীতির প্রতিকার করবে কে?

Advertisement

স্বপন চক্রবর্তী, জগৎবল্লভপুর, হাওড়া

আঁতাঁত রাজনীতি

আমাদের মতো রাজ্যে আইনের কড়া নজরদারি প্রান্তিক মানুষের ভাত-কাপড়ের সমস্যা ডেকে আনে। তার প্রভাব পড়ে ভোটে— যথার্থ কথাই বলেছেন ঋতজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে। সত্যি, ভোট বড় বালাই। ভোটব্যাঙ্ক বজায় রাখতে সরকার সব রকম পন্থা অবলম্বন করবে, এ আর বিচিত্র কী? ভাঁড়ে মা ভবানী হলেও বাজার থেকে ঋণ নিয়ে দান-খয়রাতির ব্যবস্থা তো করতেই হবে। তার হাতেগরম ফল কী হতে পারে, এই বারের লোকসভা নির্বাচনে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-সহ বিভিন্ন সরকারি অনুদান দেখিয়ে দিল। ভোটের পর মুখ্যমন্ত্রীর হুকুমে কিছু শহরে বেআইনি দখলদার উচ্ছেদ অভিযান শুরু হতেই অভিযান থমকে গেল এক মাসের জন্য। আসলে উচ্ছেদ অভিযানে হকাররা কিছুটা আঘাত পেলেও এক মাসের ‘সমীক্ষা’-র পর হকাররা স্থায়ী ভাবে পাবেন পুনর্বাসন। আর এই পরিস্থিতিতে শাসক দলও হকারদের বুঝিয়ে দিতে চাইল, আমরা তোমাদেরই লোক, ফলে ভোটটা দিয়ো। বাস্তবিকই তাই— যে কোনও জনসভা ভরানোর জন্য এই হকাররাই অন্যতম ভরসা।

রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ব্রিগেড ভরানোর জন্য তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর উপরই নির্ভর করতেন। আর তিনি কলকাতা অঞ্চলের গাড়ি চালক ও হকারদের সংগঠিত করে ব্রিগেড ভরাতেন। কাজেই অটো চালক, ট্যাক্সি চালকদের দাদাগিরি সহ্য করতে হত বইকি। এই আমলেও হকাররা বেআইনি ভাবে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন, এতে পথচারীদের অসুবিধা হলে কী আর করা যাবে। কী শহর কী গ্রাম, সর্বত্র একই অবস্থা। সাধারণত এখানে স্থানীয় নেতাদের মনসবদারি চলে। এক-এক জন নেতা বালি, কয়লা, চাকরি, হকার, বেআইনি নির্মাণের ইজারা নিয়ে বসে আছেন। ফলে, বড় শিল্প এখানে অধরাই থাকে। কারণ, বড় শিল্পপতিরা সিন্ডিকেটের দাদাগিরি মানতে চাইবেন না। অনেক দিন ধরে চলা অন্যায়ের নির্মাণ কি আর এক দিনেই ভাঙা যায়?

দেবাশ্রিত রায়, রানাঘাট, নদিয়া

বিকল্প ব্যবস্থা

সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে যেন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, ভাঙা গিয়েছে অসংখ্য মানুষের রুটি-রুজির একমাত্র আশ্রয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, রাস্তা বা ফুটপাত দখল করে অবাধ হকারি সুস্থায়ী উন্নয়ন পথের বিরোধী। আবার যখন ফুটপাত দখলের অধিকার কোনও রাজনৈতিক নেতা টাকার বিনিময়ে পাইয়ে দেন, তখন তা অবশ্যই নৈতিকতার বিরোধী। তবে এটাও সত্যি যে, এই সমস্যার উত্তর কখনও নির্বিচারে বুলডোজ়ার চালনা হতে পারে না। তা হলে এই সমস্যার সমাধান কোথায়?

সমস্যা সমাধানে সাধারণত যে পথটি বাতলানো হয়, তা হল হকারিকে আইনসঙ্গত করা। বৈধ কাগজপত্র সরবরাহ করে তাঁদের ব্যাঙ্ক-ঋণ পাওয়ার পথ প্রশস্ত করা বা আইন মেনে বৈধ নির্মাণে কিংবা জমিতে দোকানঘর ভাড়া পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। এর মাধ্যমে অসংগঠিত হকারিকে আস্তে আস্তে সংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে নিয়ে এসে রাস্তা বা ফুটপাত দখল যেমন আটকানো যেতে পারে, একই ভাবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি রোখা সম্ভব হতে পারে।

১৯৭৫ সাল থেকে রাজ্যের হকার সমস্যার সমাধানে উপরোক্ত দু’টি রাস্তায় হাঁটা হয়েছে, কিন্তু সমাধানের অঙ্ক মেলেনি। না মেলার কারণটি সহজবোধ্য। প্রথমত, এই হকারদের মধ্যে যাঁরা একেবারে প্রান্তিক, তাঁদের যতই হকারির বৈধ কাগজপত্র থাকুক, তাঁরা ব্যাঙ্ক-ঋণ পান না অথবা বৈধ জমি বা নির্মাণে দোকানঘর ভাড়া নিতে পারেন না। কারণ, ব্যাঙ্ক কিংবা ভাড়া প্রদানকারী ব্যক্তির কাছে এঁরা অর্থনৈতিক ভাবে বিশ্বাসযোগ্য নন। দ্বিতীয়ত, হকারদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হওয়ায়, শহরের একটি-দু’টি জায়গায় ‘হকিং জ়োন’ তৈরি করে দিয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব নয়। ‘হকিং জ়োন’ সম্পৃক্ত হয়ে গেলেই আবার রাস্তার ধারে বা ফুটপাতে হকাররা বসতে শুরু করবেন। তৃতীয়ত, হকারদের বৈধ কাগজপত্র দেওয়াকে কেন্দ্র করে আবারও রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি শুরু হয়ে যায়।

হকার সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে গেলে এঁদের সংখ্যায় রাশ টানা প্রয়োজন। হকার সমস্যার উৎস অবশ্যই সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের অভাব। বেশি রোজগারের আশায় মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন এবং সেখানে সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের অভাব তাঁদের হকারির দিকে ঠেলে দেয়। গ্রাম থেকে শহরের দিকে শ্রমের অভিবাসন আটকাতে কার্যকর দাওয়াই হতেই পারে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, যে প্রকল্পকে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং সেখানে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের সরবরাহকে নিরবচ্ছিন্ন করা রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা হওয়া উচিত। এর পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে নির্দিষ্ট পণ্যভিত্তিক ক্লাস্টার তৈরি করা যেতে পারে। এমন ক্লাস্টার আঞ্চলিক দক্ষতাকে স্থানীয় ভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনতে সক্ষম। শহরেও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। যে প্রকল্পের মাধ্যমে শহরের নিকাশিব্যবস্থা উন্নত করা, রাস্তাঘাট তৈরি বা মেরামতের মতো কাজ করা যেতে পারে। এখানে প্রচুর অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয় বলে নির্ধারিত মজুরিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।

এই ভাবে শুধুমাত্র হকার সমস্যার একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধানই নয়, বিকল্প শিল্পায়নের এবং আর্থিক সমৃদ্ধির পথটিকেও খুঁজে নেওয়া যায়। এই সমাধানের পরে আর কখনও কোনও বুলডোজ়ারের প্রয়োজন পড়বে না উচ্ছেদ অভিযান চালানোর জন্য।

প্রতীপ কুমার দত্ত, বোলপুর, বীরভূম

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement