‘জনসংখ্যার জুজু’ (৩০-১১) সম্পাদকীয় হতাশ করল। স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই, দেশে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চিন্তায় এই পত্রলেখকেরও ‘রাতে ঘুম হয় না’। উদ্বেগের দিকটি তো সম্পাদক নিজেই তুলে ধরেছেন— “জনসংখ্যা যখন স্থিতিশীল, তখন শিক্ষিত, স্বাস্থ্যবান শ্রমশক্তি দেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে লইয়া যাইতে পারে। অথচ দেশ জুড়িয়া জনস্বাস্থ্য এবং শিক্ষায় বিপুল ঘাটতি ক্রমশ বাড়িয়া চলিয়াছে...।” প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর পার হয়ে গেল, দেশের কর্ণধাররা উন্নয়নের এই দিকটা এত দিনেও গুরুত্ব দিয়ে ভেবে উঠতে পারলেন না কেন? কেন দেশে এত কর্মহীনতা, দারিদ্র, শিক্ষা-পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের অভাব? দুঃখের কথা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, অসম প্রভৃতি রাজ্যের সাম্প্রতিক কালের দুই সন্তান নীতিকেও কটাক্ষ করে বলা হয়েছে, শাস্তির ভয় দেখানোর পন্থা অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক ও অপ্রয়োজনীয়।
আজ সাদা চোখে যে বিষয়গুলো ক্রমাগত ভাবিয়ে তুলেছে তা হল, দেশের খনিজ সম্পদ, পানীয় জল, চাষবাসের সুযোগ-সুবিধা— বাড়ছে না কোনও কিছুই। নাগরিকপ্রতি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা, ডাক্তার-নার্স অপ্রতুল; পড়ুয়াদের তুলনায় শিক্ষাকেন্দ্র এবং শিক্ষকের অনুপাত আশঙ্কাজনক; জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অধিক সংখ্যায় গৃহ নির্মাণ, সড়ক-রেলপথ তৈরির পাশাপাশি কর্মহীনতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে। আজ কোভিড সংক্রমণের কারণে দূরত্ব বজায় রাখাকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু ভেবে দেখা হচ্ছে না, হাটে-বাজারে বা যে কোনও অফিস-সময়ে একটা ভিড় স্টেশনে নিত্যযাত্রীদের কী পরিমাণ ভিড় থাকে। আমরা পরিবেশ দূষণের কারণে, বৃক্ষচ্ছেদের জন্যে, ভূগর্ভের অতিরিক্ত জল তুলে ফেলাকে জনসচেতনতার অভাব বলে দায়ী করি। কিন্তু এক বারও ভেবে দেখি না গলদ আসলে কোথায়!
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
চিন্তার বিষয়
শাশ্বত ঘোষ ‘জনসংখ্যার গতিবিধি’ (১-১২) শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত জনসংখ্যা অভিক্ষেপ রিপোর্ট (পিপিআর) অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০৩৬-এর মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা ১২১ কোটি থেকে ১৫২ কোটিতে গিয়ে পৌঁছবে, বার্ষিক গড় বৃদ্ধি হবে ১.০২%। তাই, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা এখন চিন্তার বিষয় নয়— এই জনসংখ্যাকে কী ভাবে কর্মদক্ষ করে তোলা যায়, সেটাই এখন মূল ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত।” কেন্দ্রীয় রিপোর্টের পাশাপাশি বিশ্বের জনসংখ্যার সামগ্রিক ইন্টারপোলেশন বা প্রক্ষেপণের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশদ সমীক্ষা বা পর্যালোচনার রিপোর্টও এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। সেই সূত্রে প্রশ্ন উঠে আসে, ভারতের পক্ষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষাটি কতটা স্বস্তিদায়ক? সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১ জুলাই ২০২১-এ ভারতের জনসংখ্যা ১৩৯ কোটিরও বেশি। এখানে ২০২১ সালের সম্ভাব্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.০২ শতাংশ। ২০২২, ২০২৩, ২০২৪, ২০২৫ ইত্যাদি পরের বছরগুলিতে সম্ভাব্য বৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ১.০০, ০.৯৭, ০.৯৫ ও ০.৯২ শতাংশ হিসাবে। ২০৬০ সাল এলে, ভারতের লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সেই হার কমে হয়েছে মাত্র ০.০৩ %। ২০৬৫ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, এ দেশের জনসংখ্যা আর বৃদ্ধির দিকে না গিয়ে ‘ঋণাত্মক’ হারে কমেছে। তখন সেই হার হবে (–) ০.০৮ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০৬০ সালে দেশের লোকসংখ্যা হবে ১৬৫ কোটিরও বেশি। সেই সঙ্গে এটাও দেখা যাচ্ছে, নারী শিক্ষা, দারিদ্র বিমোচন, নগরায়ন এমন কিছু বিশেষ কর্মসূচির বিকাশের ফলে দেশে জনসংখ্যার হার কয়েক বছর ধরে কমলেও, জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত ২০২৬ সালের পর থেকে চিনকে স্পর্শ করবে বা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ, উভয় দেশের লোকসংখ্যা হবে ১.৪৬ বিলিয়ন বা ১৪৬ কোটিরও বেশি। এখানে উল্লেখ্য, চিনের অর্থনীতি ভারতের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বড়। চিনের জিডিপি যেখানে ১৪.৯ ট্রিলিয়ন ডলার, ভারতের সেখানে ২.৬ ট্রিলিয়ন ডলার।
জনসংখ্যার নিরিখে সবচেয়ে জনবহুল দেশের শিরোপা মাথায় নিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ভারতের কাছে এমন অমোঘ সমস্যাটি পর্যায়ক্রমে ঠিক কতটা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে? এর মধ্যে সত্যিই কি কোনও ‘চিন্তার বিষয়’ নেই? জনসংখ্যাকে কী ভাবে কর্মদক্ষ করে তোলা যাবে, যাতে ভারত চিনকে টপকে সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ হয়ে তার সব রকম কঠিন অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে নিপুণ ভাবে বেরিয়ে আসতে পারবে?
পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি
সামাজিক দ্বন্দ্ব
শাশ্বত ঘোষের বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধটি সময়োপযোগী এবং চিন্তা উদ্রেককারী। ছিন্নমূল বাঙালির প্রাণের শহর কলকাতা। এই কল্লোলিনীকে নিয়ে গর্ব করেননি এমন বাঙালি বিরল। কিন্তু এই শহরের সৌন্দর্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মিশেল এখন ইতিহাস। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই শহরে একটা ছোট্ট মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করা বাঙালির সংখ্যা অগণিত। কালের প্রবাহে, পারিপার্শ্বিক ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতায় পরিবার হয়েছে সঙ্কুচিত। বিশ্লেষণ হিসাবে ২০৩৬ সালে ভারতের বার্ধক্যপ্রাপ্ত জনসংখ্যা যখন হবে মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা হবে ১৮ শতাংশ, এবং কলকাতার ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ। এটা বোধগম্য যে, জনসংখ্যার নিরিখে নবীন ও প্রবীণের ভারসাম্য হারিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তথা প্রাণের কলকাতা। লেখক যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তা সর্বাংশে সত্যি—পশ্চিমবঙ্গের এই নিম্নমুখী জনসংখ্যার জন্য অন্যান্য রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবাধ আগমন পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক দ্বন্দ্বের জন্ম দিতে পারে। বিশেষ করে ভাষা ও সংস্কৃতির পরিসরে। এটা অতীব চিন্তার বিষয়। শুধু তা-ই নয়, এর প্রভাব কলকাতার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর ভয়াবহ ভাবে ইতিমধ্যেই পড়ছে। বড়বাজার, গ্র্যান্ড হোটেল পরিসর, বি টি রোডের দু’পাশের ফুটপাত এরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ মাত্র।
সুব্রত দত্ত, কলকাতা-৫৮
ইতিবাচক
সম্প্রতি ভারতের জনসমীক্ষায় এক নতুন বিষয় উঠে এসেছে, যা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানে নতুন ভাবে গবেষণার কাজ শুরু করা যেতেই পারে। ভারত হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের বাকি দেশগুলোর কাছে পথপ্রদর্শক। সম্প্রতি জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্টে উঠে এসেছে প্রতি ১,০০০ জন পুরুষের অনুপাতে নারীদের অনুপাত ১০২০। ১৯৯০ সালে নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস-এর একটি নিবন্ধে অমর্ত্য সেন ভারতকে ‘কান্ট্রি অব মিসিং উইমেন’ বলেছিলেন। তখন নারী-পুরুষ অনুপাত ছিল ৯২১:১০০০। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওঁর বক্তব্য তখন সমীচীন ছিল। পরে ২০১৫-১৬’এর এনএফএইচএস-৪’এর সমীক্ষায় সেই অনুপাত কমে দাঁড়ায় ৯৯১:১০০০। সম্প্রতি এনএফএইচএস-৫’এর সমীক্ষা অনুযায়ী, এখন নারী-পুরুষের অনুপাত ১০২০:১০০০ হয়েছে। নিঃসন্দেহে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগ শিশুভ্রূণ হত্যা, নারীকল্যাণ, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে যে সব পদক্ষেপ করেছে, তার সুদূরপ্রসারী ও ইতিবাচক ফলাফল আজকের এই সমীক্ষা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভারত নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম, তার আভাসও পাওয়া গিয়েছে।
একই সঙ্গে মহিলাদের প্রশাসনিক বিষয়ে এগিয়ে আসার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যকে উৎসাহ দিতে হবে। এবং বিলোপ করতে হবে মহিলা সংরক্ষণের চিন্তাধারাটিও। শুধুমাত্র হেঁশেল ও সংসার সামলানোর দায়িত্বে তাঁদের আটকে রাখা হলে তা এই নতুন প্রকাশিত অনুপাতের ভারসাম্য বা মান কোনওটারই মর্যাদা রক্ষা করবে না।
শুভজিৎ বসাক, কলকাতা-৫০