ঈশা দাশগুপ্তের ‘মাতৃভাষায় পড়ি, এই অহঙ্কার’ (১৮-১২) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা যায়— ভারতের মতো বহু ভাষাভাষীর দেশে নিজেদের মধ্যে যোগসূত্রের মাধ্যম তা হলে কোন ভাষা? হিন্দি বহুলব্যবহৃত হলেও তা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। সর্বভারতীয় স্তরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ায় প্রাথমিকে আবার ইংরেজি ফিরিয়ে আনা হয়েছে এবং রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি মাধ্যমেও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জয়েন্টে সফল ছাত্রছাত্রী, বিখ্যাত বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা বা ইসরো-র নবীন বিজ্ঞানী, কেউ-ই মেধার দিক থেকে সাধারণ মানের নন। বিদ্যালয় স্তরে তাঁরা আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষা লাভ করলেও, পরবর্তী কালে ইংরেজি ভাষা সহজেই আয়ত্ত করছেন। ইংরেজিতে সড়গড় না হলে উচ্চতর শিক্ষার জন্য দেশ-বিদেশের নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ মিলবে কি? কী ভাবেই বা সম্ভব গবেষণার কাজ বা তার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি?
রাজ্য সরকারের চাকরিতে বাংলা জানার শর্ত নতুন নয়। এ রাজ্যে কর্মরত অবাঙালি আইএএস বা আইপিএসদের চাকরিতে ‘কনফার্মেশন’-এর জন্য বিভাগীয় পরীক্ষায় অন্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলা পত্রেও পাশ করা আবশ্যিক। রাজ্য সিভিল সার্ভিসের গরিষ্ঠ অংশের অফিসারদের ইংরেজিতে পারদর্শী করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ব্যবস্থাপনায় বিশেষ কোর্স কিছু কাল আগেই চালু করা হয়। সমাজের বৃহত্তর অংশকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে মাতৃভাষার বিকল্প নেই। কিন্তু উচ্চতর শিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজির গুরুত্বকেও অস্বীকার করা সম্ভব কি?
ধীরেন্দ্র মোহন সাহা
কলকাতা-১০৭
শেখানোর ত্রুটি
‘মাতৃভাষায় পড়ি, এই অহঙ্কার’ প্রবন্ধে লেখিকা আমাদের রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের কিছু অংশ ক্লাসে বসে, বাকিরা যন্ত্রের পর্দায়। বেশ কয়েকটি হাত উঁচু করে বলছে “ম্যাম, যা বোঝালেন, আরও এক বার বলবেন— মানে, বাংলায়।” নামী বেসরকারি ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে অনেক কষ্টে পয়সা জোগাড় করে পড়তে আসা মেধাবী ছাত্রটিরও একই সমস্যা। সমস্যা, ইংরেজি ভাষায়। লেখিকা ‘যে অভিভাবকেরা অন্য রকম ভাবার সাহস’ দেখিয়েছেন, তাঁদের ঘরের ছাত্রছাত্রীদেরই কলেজে ইংরেজি ভাষায় অধ্যাপকের পড়ানো বুঝতে না পারার কথা উল্লেখ করেছেন। ত্রুটিপূর্ণ ইংরেজি শিক্ষাই এর একমাত্র কারণ। এক জন প্রাপ্তবয়স্ক কলেজ শিক্ষার্থী যেখানে কিছু ইংরেজি পড়ে এসেও ইংরেজি ভাষায় পড়ানো বুঝতে পারছে না, সেখানে একটি শিশুকে আমরা যখন ধরে-বেঁধে প্রাক্-প্রাথমিক স্তর থেকেই মাতৃভাষার পরিবর্তে অপরিচিত ইংরেজি ভাষায় পাঠ গ্রহণে বাধ্য করি, তখন তাকে কী ধরনের অসহনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সে বিষয়টি আমরা বিবেচনার মধ্যেই আনি না। এ কথা ঠিক যে, ধীরে ধীরে এই শিশুরা প্রায় সকলেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যায়। সাধারণত অভিভাবকেরা পরীক্ষান্তে মূল্যায়ন পত্রে নম্বর দেখে আত্মতৃপ্তি পান।
শেষ পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েদের কত জন কোথায় কোন কাজে কর্মজীবনে সাফল্য লাভ করল, তার কোনও পরিসংখ্যানও আমাদের সামনে হাজির করা হয় না, যেটা অত্যন্ত জরুরি। মাতৃভাষায় পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের সাফল্যের খবর আজও সংবাদমাধ্যমে বারে বারে প্রকাশ করা হয়। “এক জনের বাবা মুদি দোকানের সামান্য বেতনের কর্মী। অন্য জনের বাবা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাছ বিক্রি করেন। টানাটানির সংসার। কিন্তু, মেধা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করার নেশা তাঁদের দু’জনেরই। তারই জোরে সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষা নিটে নজরকাড়া ফল করেছেন বীরভূমের আলো মণ্ডল এবং হাওড়ার রিভু ভক্তা”, পূর্ব মেদিনীপুরের দেরিয়াচক শ্রী অরবিন্দ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে শেখ ইজাজুর রহমন ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার চাকরি পেয়েছেন, দিনমজুরের ছেলে উজ্জ্বল শেখ ডাক্তারি প্রবেশিকা নিট-এ নজরকাড়া ফল করেছেন, এক সময় ঘুঁটে বিক্রি করে, ঠোঙা বানিয়ে ছেলেদের পড়াতে হয়েছে মাকে। এমন পরিবার থেকে উঠে আসা এক শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ উজ্জ্বল পোদ্দার গবেষণার জোরে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন, সম্পূর্ণ সরকারি খরচে পড়াশোনা করে এ বার সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় ৪৪৫ স্থান পেয়েছে মুর্শিদাবাদের স্বরূপ সরকার— নানা সময়ে এই ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের খবর সংবাদে উঠে এসেছে, যা গরিব ঘরের ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করতে সাহায্য করে। কিন্তু সচ্ছল পরিবারের অভিভাবকেরা অনেকেই এদের সঙ্গে নিজের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাতে কুণ্ঠাবোধ করেন। “আমার ছেলে/ মেয়ে বাংলা পড়তে পারে না” এমন কথা কিছু মা-বাবা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে গর্ব বোধ করেন। মাতৃভাষা পড়ি— এই অহঙ্কার চিন, জাপান, জার্মান, রাশিয়া, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের ছেলেমেয়েরা করতে পারে। কারণ ও দেশের মানুষ ভাষাবিজ্ঞান স্বীকৃত মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়।
ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠনের চাকচিক্যে অনেকেই আসল ফাঁকি কোথায়, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না। ফলে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে অপরকে অনুসরণ করে ‘নিজেদের মতো সন্তানকে বাজারের শর্তে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত থাকতে’ ভালবাসছেন। এর ভুল কোথায় কী ভাবে শিক্ষার্থীদের বিপদের সম্মুখীন করতে পারে, তা তুলে না ধরে, আমরা মাতৃভাষার পক্ষে জয়ধ্বনি দিয়ে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। ‘ইংরেজি বলতে না পারলে কিচ্ছু হবে না’ গোছের প্রচারের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার সংগঠিত করার আগ্রহ দেখাচ্ছি না।
রাজ্যের অধিকাংশ সরকারি বিদ্যালয়ের শ্রীহীন অবস্থার বিপরীতে উন্নত পরিকাঠামোযুক্ত বেসরকারি ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত বিদ্যালয়ের আকর্ষণ বেশি হতে বাধ্য। শিক্ষায় ‘ভাষাবিজ্ঞান’-এর গুরুত্ব সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষেরই বিশেষ কোনও ধারণা আছে, এমন উদাহরণ আমাদের নজরে আসে না। তাই যাঁরা ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ বলে প্রচারে নেমেছিলেন, তাঁদেরই একাংশ সবার আগে নিজের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলিতে পড়ান, এমন অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে যায়। এমন দৃষ্টান্ত সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
রতন রায়চৌধুরী
কলকাতা-১১৪
সতর্কতা
এমন অনেক রোগ আছে, যা উপেক্ষিত হলে সমাজ সুস্থ নীরোগ প্রজন্ম উপহার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এ কারণে সর্বপ্রথম দরকার বিবাহের আগে রক্তপরীক্ষা বা ‘ফ্যামিলি স্ক্রিনিং’ করে নেওয়া। প্রায়শই দেখা যায়, ‘পাত্র-পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনে কোষ্ঠী রাশি ইত্যাদি বিচার, যার কোনওটাই সমাজকে সুস্থ সবল প্রজন্ম উপহার দেওয়ার মাপকাঠি হতে পারে না। কারও বিশ্বাসে আঘাত না করে আমার অনুরোধ, এর পাশাপাশি রক্তপরীক্ষা করে নেওয়ার ব্যাপারে আমরা যদি দায়িত্ববান হই, বিবাহ-পরবর্তীতে অনেক বড় সমস্যা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি। ধরা যাক, কারও রক্তপরীক্ষায় দেখা গেল সেই ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়া বাহক, যা কিনা বিন্দুমাত্র ভীতিকর নয়, প্রয়োজন শুধুমাত্র সচেতনতার। তিনি যাঁকে বিবাহ করতে চলেছেন, তিনিও থ্যালাসেমিয়া বাহক না হলে সমাজ পরবর্তীতে সুস্থ প্রজন্ম উপহার পেতে পারে। সবশেষে অনুরোধ, চিকিৎসকমহল ও সংবাদমাধ্যম বংশগত রোগ ও রক্তপরীক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারমূলক ব্যবস্থা করলে সমগ্র জনসমষ্টি উপকৃত হতে পারে।
স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা-২৫