নতুন পুরসভার কাছে আমার শুধু একটাই প্রত্যাশা— স্বচ্ছ কলকাতা। স্বচ্ছ ভারতের জন্যে ১৩০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, নির্মল বাংলার জন্যে ২৬৬১ কোটি টাকা। কিন্তু স্বচ্ছ কলকাতার জন্যে কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তা আমার জানা নেই। এখানে যে কোনও পোস্টার লাগানোর পরে তা বছরের পর বছর লাগানোই থাকে। পুরসভার কোনও ব্যবস্থা নেই জরিমানা করার। কলকাতায় সব রাজনৈতিক পোস্টার সরাতে পারলে কলকাতা অন্তত ৭০% পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর রাস্তার ধারে ধারে দুটো করে নীল-সবুজ ডাস্টবিন রাখতে পারলে ভাল হয়। যদি আবার রাস্তা ধোয়ার ব্যবস্থা চালু হয় তবে ভাল হয়। আমরা বাড়িতে ‘কনসিলড ওয়্যারিং’ করি, কিন্তু রাস্তার কেবল-ইলেকট্রিক আর টেলিফোন তারের জঞ্জাল ঢাকা দেওয়ার কথা কেন চিন্তা করি না? আসলে স্বচ্ছ কলকাতা আমাদের ভাবনায় নেই। বাঙালির সিভিক সেন্স-এর উদাহরণ হল যাদবপুরের আন্ডারপাস, যা জঙ্গলে পরিণত।
কলকাতা পরিষ্কার রাখতে গেলে কিছু কড়া সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। সিঙ্গাপুরের মতো জরিমানা চালু করতেই হবে। সিঙ্গাপুরে যেমন রাস্তায় চুইংগাম খাওয়া বারণ, তেমনই এখানে গুটখা বা ওই জাতীয় জিনিস খাওয়া বন্ধ করতে হবে। আমরা জঞ্জালনগরী থেকে তিলোত্তমা করতে পারব কলকাতাকে, যদি নতুন পুরসভা পথ দেখায়।
মিতালি মুখোপাধ্যায় (খাঁ)
কলকাতা-৮৪
ঐতিহ্য
মানিকতলা বাজার বা নিউ মার্কেটের ঘড়ি মিনার, কিংবা সুবোধ মল্লিকের বাড়ি সংরক্ষণের দাবিকে সমর্থন করেই বলি, সব সময় বড় বড় নির্মাণই ‘হেরিটেজ’ বলে গণ্য হবে, তা কিন্তু নয় (‘পুজো উন্মাদনার সিকিভাগও জুটলে বেঁচে যেত শহরের ঐতিহ্য’, ১৮-১২)। ভারত, তথা এশিয়াতে যে সব শহরে প্রথম জলের কল বসে, তার অন্যতম কলকাতা। সময়টা ছিল ১৮৭০ সাল। কলকাতার রাস্তায় বসল জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য জলের কল। গ্রিক-রোমান স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে তৈরি সিংহমুখী লোহার তৈরি কলগুলিকে সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে আনা হয়। জলবণ্টনের দায়িত্বে থাকে ক্যালকাটা ওয়াটার ওয়ার্কস। এখনও ওরিয়েন্টাল সেমিনারির উল্টো দিকে গরানহাটা রোডে এই কল দেখা যায়। জলের উৎস ছিল— পলতা। পলতাতে হুগলি নদীর জল পাম্প করে তুলে পরিশুদ্ধ করে পাইপের মারফত কলকাতাতে পাঠানো হত। এই দীর্ঘ ১৬ কিমি জলের যাত্রাটি পুরোপুরি মাধ্যাকর্ষণ-নির্ভর ছিল। জল নিয়ে আসা হত কলকাতার টালা (তখন টালা ট্যাঙ্ক হয়নি) এবং ওয়েলিংটনের পাম্পিং স্টেশনে। আর তার পর সেই জল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যেত সিংহমুখ কলের মাধ্যমে।
তবে জলের কল বসানোর শুরুটা সহজ হয়নি। কল বসানোর কয়েক দিনের মধ্যে রটে গেল যে, কলের ‘ওয়াশার’-এ গরু বা শুয়োরের চামড়া ব্যবহার করা হয়ছে। মাত্র ২৩ বছর আগে ঘটে যাওয়া সিপাহি বিদ্রোহের ভয়াবহ স্মৃতি সাহেবদের মনে তখনও টাটকা। তবে শোভাবাজার রাজবাড়ির উদ্যোগে ব্যাপারটা বেশি দূর গড়াতে পারেনি। কলকাতাবাসী বুঝতে পারেন, কলের ওয়াশারে কোনও নিষিদ্ধ পদার্থ নেই। কিন্তু কলকাতার বিপুল জনসংখ্যার জন্য সিংহমুখ কলের জল পর্যাপ্ত হয়নি। তখন প্রয়োজন হয় একটি বড় ট্যাঙ্কের। সেই প্রয়োজন মেটাতেই ১৯০৯ সালে তৈরি হয় টালা ট্যাঙ্ক, যা ১০০ বছর পরেও জল সরবরাহ করে যাচ্ছে। টালা ট্যাঙ্কের গুরুত্ব এতটাই বেশি ছিল যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বোমা থেকে বাঁচতে টালা ট্যাঙ্কের মাথায় কৃত্রিম ঘাস লাগানো হয়, যাতে যুদ্ধবিমানের পাইলটরা বোমা না ফেলেন।
টালা ট্যাঙ্ককে আমরা মনে রেখেছি, কিন্তু সিংহমুখ কলদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। ১৩০ বছর পার হয়ে গেলেও গুটিকয়েক এই কল এখনও কলকাতার রাস্তায় দেখা যায়। আমাদের অজানতেই এদের পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে যাই, কিন্তু এদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় আমরা পাই না। ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, উপরে সিংহের মুখ, যা দিয়ে এক সময় জল পড়ত। সিংহের মুখের ঠিক নীচে ক্যালকাটা ওয়াটারওয়ার্কস (সিডব্লিউডব্লিউ) লোগো। তার উপরের অংশে ইংরেজিতে লেখা, ‘ওয়ান্ট নট, ওয়েস্ট নট’। গোলাকার অংশের নীচে বাংলায় লেখা ‘অপচয় করিও না, অভাবও হবে না।’ তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলগুলির অবস্থা শোচনীয়। লেখাগুলো আর ভাল করে পড়া যায় না, বাংলা লেখাটার অবস্থা আরও খারাপ।
রাস্তার ধারে অবস্থিত এই তিন ফুট উচ্চতার কলগুলোও কলকাতার ঐতিহ্য, কলকাতা পুরসভার ‘হেরিটেজ’ তালিকায় এদের স্থান আছে। আর এক দিক থেকে দেখতে গেলে হেরিটেজ কিন্তু শুধু বাড়ি, সৌধ বা মূর্তির মতো নির্মাণ নয়, এর মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও থাকে। এই শতাব্দী শুরুতে তৎকালীন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব কোফি আন্নান বলেছিলেন, মিষ্টি জলের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতাই হয়তো ভবিষ্যতে যুদ্ধের কারণ হবে। তার ১৩০ বছর আগে কলকাতা কর্পোরেশনের উদ্যোগে জল সংরক্ষণের বার্তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল জলের কলের মাধ্যমে। ভাবতে অবাক লাগে, আজ এই প্রাচীন কলগুলির পাশে নতুন কল দিয়ে অবিরাম ধারায় জল বেরিয়ে যায়, অপচয়ের সীমা থাকে না। অথচ, আজ যখন জল সঞ্চয়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, ঠিক
তখনই আমরা সেই অমূল্য বার্তা ভুলতে বসেছি।
রঙ্গন দত্ত
কলকাতা
ঝুপড়িই নিয়তি?
কলকাতায় আবার একটা পুরভোট হয়ে গেল। টালা ব্রিজের কাজের জন্য উচ্ছেদ হওয়া বস্তিবাসী মানুষদের তরফ থেকে জানতে চাই, কবে কলকাতার খেটে-খাওয়া মানুষদের স্থায়ী বাসস্থান ও অন্যান্য পরিষেবার সুব্যবস্থা হবে? টালা ব্রিজের নীচের দু’দিকের রাস্তার ধারে আমরা পরিবার নিয়ে বাস করে আসছিলাম। অনেকের এখানে কয়েক পুরুষের বাস। এলাকার ‘বাবুদের বাড়ি’ আমরা ঠিকে কাজ করছি বহু বছর ধরে। আমাদের স্বামীরা কেউ রিকশা চালান, কেউ ফুচকা বিক্রি করেন, কেউ আবার মুটে-মজুরের কাজ করেন। কষ্ট করে রোজগার-করা পয়সায় অল্প অল্প করে থাকার জায়গাগুলো পাকা করে নিয়েছিলাম। ২০১৯-এ স্থানীয় প্রশাসন প্রথমে বলে ব্রিজের কাজ হবে, তাই আমাদের ঘর খালি করে দিতে হবে। কয়েক মাস বাদে আবার বলা হয় যে, দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে চলে যেতে হবে, ব্রিজের কাজ হয়ে গেলে আবার ঘরে ফিরতে পারব। ফের বলা হয়, এই ঘর ভাঙা হবে। প্রশাসন অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেছে, সেখানে চলে যেতে হবে।
প্রশাসন উঠিয়ে দেওয়ার পরে অনেক মামলা করে, লড়াই করে আমরা প্রায় ১৪০টি পরিবার আর জি কর খালপাড়, পি কে মুখার্জি রোড খালপাড়, চিৎপুর রেল ইয়ার্ড, ৯১ বাসস্ট্যান্ড, গৌরীবাড়ি খালপাড়ে কালো প্লাস্টিক ঘেরা ঘুপচি ঘর পেয়েছি। এখানে শৌচাগারের কোনও ভাল ব্যবস্থা নেই। পাশেই খালের ধারে শুয়োর পালন হয়, ফলে বাচ্চাদের নিয়ে থাকা খুবই অসুবিধাজনক। অধিকাংশ ঝুপড়িতেই কেবল সন্ধ্যা ৫টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ মেলে। বিদ্যুতের নতুন কানেকশনের ব্যবস্থা বহু চেষ্টার পরেও হয়নি। প্লাস্টিকে ঘেরা ছোট ঘরেই আগুন জ্বেলে আমাদের কাজ করতে হয়। সব সময়েই আমরা আতঙ্কে থাকি।
আমরা চাই, স্থানীয় প্রশাসন আমাদের থাকার জন্য একটা ভাল ব্যবস্থা করে দিক। আমাদের তো ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটু ভাল ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমরা কাজ করি বলেই এই শহরটা চলে। আমরা শহরবাসী, অথচ আমাদের শুধুমাত্র ‘বস্তিবাসী’ হিসাবে, দয়ার পাত্র হিসাবেই এত দিন দেখে আসা হয়েছে। আমাদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার, কাজ করার অধিকারের কথা কারও কানে পৌঁছয়নি।
লক্ষ্মী দাস
কলকাতা-২