Christmas 2024

সম্পাদক সমীপেষু: সে কালের বড়দিন

উৎসবের দিনে অন্যদের ছুঁয়ে যাওয়ার আর একটি মাধ্যম, অর্থাৎ উপহার আদানপ্রদানের রেওয়াজেও এসেছে ভাটার টান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৮

কলকাতার কড়চা বিভাগে ‘কেক, ক্রিকেট, কমলালেবু’ (২১-১২) কলকাতার শীতের পুরনো আমেজকে মনে করিয়ে দিল। মনে পড়ল শীতের কলকাতার সবচেয়ে বড় উৎসব ক্রিসমাসের কথা। এখন পার্ক স্ট্রিটের আলোকসজ্জা দেখতে যাওয়া, খাওয়াদাওয়া আর পার্টি করার মধ্যেই ক্রিসমাসের উদ্‌যাপন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেকটাই যেন চাপা পড়ে গেছে বড়দিনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা নানা সামাজিক রীতি। হাতে আঁকা গ্রিটিংস কার্ডের জায়গায় নামী ব্র্যান্ডের ঝাঁ চকচকে কার্ডের বিরতি শেষে মোবাইল ফোনের শুভেচ্ছাবার্তা ‘ফরোয়ার্ড’ করার মধ্যে ইতি ঘটেছে সমস্ত ব্যক্তিগত স্পর্শের। উৎসবের দিনে অন্যদের ছুঁয়ে যাওয়ার আর একটি মাধ্যম, অর্থাৎ উপহার আদানপ্রদানের রেওয়াজেও এসেছে ভাটার টান।

Advertisement

কড়চায় আশাপূর্ণা দেবীর স্মৃতিকথায় বাঙালি বাড়ির বড়দিন উদ্‌যাপনের যে উল্লেখ রয়েছে, সেই সূত্র ধরেই মনে পড়ে সাহিত্যিকের মা সরলাসুন্দরী দেবীর কথা। তাঁর আমলে কোনও কোনও বছর গৃহসহায়কদের একটা করে চাদর বা কম্বল দেওয়া হত। সেটা গৃহকর্ত্রী আনুষ্ঠানিক ভাবে বড়দিনের সকালেই তাঁদের হাতে তুলে দিতেন। সঙ্গে দিতেন লেবু, সন্দেশ, মোয়া, পাটালি ইত্যাদি পৌষপার্বণ বাবদ তাঁদের প্রাপ্য বাকি সব জিনিস। পার্বণীটা যেন বড়দিনের জন্যই। কালীপুজোর সময়ও আতশবাজি, মিষ্টি দেওয়া হত গৃহসহায়কদের। কিন্তু বড়দিনের ব্যাপারটাই যেন ছিল আলাদা। বড়দিনের মরসুমে টানা দশ দিন ছুটি যেন আরও উৎসবমুখর করে তুলত মানুষকে। বাড়ির কাজের লোক ছাড়াও বড়দিনের খাবারের ভাগ পেতেন বাড়ির ধোপা, গয়লা, জমাদার সকলে। বড়দিনের খাবারের মূল আকর্ষণ যে কেক, সেটা গৃহকর্ত্রী ডিম থাকার জন্য খাওয়া তো দূরের কথা, ছুঁয়েও দেখতেন না। তাই কেক কাটার দায়িত্ব নিতেন গৃহকর্তা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত। তবে নিজের ছেলে-মেয়ের ভাগের থেকে বাসন-মাজুনির ছেলের ভাগটা যেন ছোট না হয়ে যায়, সেই দিকে কড়া নজর রাখতেন গিন্নিমা। এমন নয় যে তাঁর স্বামী দেওয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করতেন। যখনই যা আনতেন, সেটাই সকলকে দেওয়ার মতো প্রচুর পরিমাণ। তবু দৈবাৎ ছোট-বড়র প্রবণতাও দেখা যেত। যেমন আমের দিনে যখন গিন্নিমা বেছে বেছে বড় আমগুলো কাজের লোকদের দিয়ে দিতেন, তখন হরেন্দ্রনাথের মুখের রেখায় উল্লাস চোখে পড়ত না। কিন্তু সরলাসুন্দরীর ছিল অন্য অভিমত। তিনি বলতেন, নিজেরা তো সব সময় ভাল খাচ্ছি। একটু ছোট-বড়য় কী-ই বা আসে যায়। কিন্তু ওরা কতটা খুশি হয় ভাবো। তাই কেক কাটার সময় থাকত তাঁর কড়া পাহারা। বলতেন, দিনটার নাম বড়দিন, তা মনে রেখো বাপু। নজর ছোট করে বোসো না যেন।

যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ অভাব অনটনের নানা চাপের মধ্যেও সেই সময় সরলাসুন্দরীর মতো সাধারণ গৃহস্থের মধ্যে মানবিক বোধ সজাগ রাখতে চেষ্টা দেখা যেত। উৎসবের দিনেও সেই প্রয়াস থাকত অটুট। কিন্তু তুলনায় অনেকটা আর্থিক সাচ্ছল্য পেয়েও আজ আমরা সেই মানসিকতার পরিচয় দিতে পারি কই?

মালবিকা পুরকায়স্থ, কলকাতা-১২৯

যাত্রাশিল্প

শীতের শুরুতে মনে পড়ে যাত্রাপালার কথা। এই শিল্পের অর্থনীতিও নেহাত মন্দ ছিল না। কিন্তু এখন সে সব আর চোখে পড়ে কই? পশ্চিমবঙ্গে সত্তর-আশির দশক ছিল যাত্রার জন্য একেবারে স্বর্ণযুগ। সেখান থেকে নানা কারণে যাত্রাপালার জনপ্রিয়তায় টান পড়ে। তবে বেশ কিছু যাত্রাপ্রেমী ও যাত্রাযোদ্ধা সেই জনপ্রিয়তা একেবারে হারিয়ে যেতে দেননি। গ্রামবাংলায় বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে এখানে-ওখানে এখনও অনেক যাত্রার আসর দেখতে পাওয়া যায়। তবে কেন্দ্রীয় ভাবে যাত্রার যে রমরমা এক সময় ছিল, তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

এই যাত্রার ইতিহাসও সুবিশাল। ব্রিটিশ আমলে স্বদেশি যাত্রার চাহিদা ছিল তুঙ্গে। সে সময় গ্রামীণ জনসমাজে ব্রিটিশ-বিরোধী চেতনা বিস্তারে এর জুড়ি মেলা ভার ছিল। স্বাধীন ভারতে যাত্রাপালার কিছু ক্ষেত্রে পৌরাণিক-ঐতিহাসিক ও কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক সমস্যার কথা উঠে আসতে শুরু করল। এই সামাজিক যাত্রাপালার পালাকার হিসেবে সে সময় বর্ধমানের মূলগ্রামের ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সত্তরের দশকে এক দিকে নকশাল আন্দোলন, অন্য দিকে কংগ্রেসি শাসন আর বামপন্থার উত্থান— এই সময় ভৈরববাবুর পালা আর কাহিনি জনগণের মন কেড়ে নিল। একের পর এক গ্রামের খোলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হতে থাকল সেই সব পালা— পদধ্বনি, রক্তে রোয়া ধান, বৌ হয়েছে রঙের বিবি... এই সব। বহু নাট্যকার সে সময় যাত্রার মাধ্যমে সমাজটাকে ধরতে চেয়েছিলেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্বপন কুমার, শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, শান্তিগোপাল দে-র মতো অবিসংবাদী অভিনেতা।

কিন্তু যুগের নিয়মে সেই সব অভিনয়, পালা ধীরে ধীরে কমে যেতে আরম্ভ করল। গ্রামীণ বিনোদনের আঙিনায় ঢুকে পড়ল টেলিভিশন। যাত্রাকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার জন্য সে সময় টেলিভিশনের অভিনেতাদের যাত্রামঞ্চে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হল। তাতে সাময়িক ভিড় হয়তো বাড়ল, কিন্তু স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল যাত্রা শিল্প। সেই থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যাত্রা চলতে থাকল। তার পর এল অতিমারি আর লকডাউন। জমায়েতের উপর পড়ল নিষেধাজ্ঞা। তখন মনে হয়েছিল, যাত্রা শিল্পের কফিনে এটাই বোধ হয় শেষ পেরেক। কিন্তু সেই দুঃসময় অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছে যাত্রাপালা। আজ গ্রামেগঞ্জে অনেক শখের দল থেকে শুরু করে কম বাজেটের যাত্রা দল আসর মাত করে দিচ্ছে। নতুন নতুন প্রতিভাধর অভিনেতা, অভিনেত্রী উঠে আসছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন যাত্রা শিল্পীর খোঁজে চালু করেছে কর্মশালা। নতুন করে মানুষ যাত্রার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এটা আমাদের মতো যাত্রাপ্রেমী সমস্ত মানুষের কাছে এক আশার আলো।

শঙ্খ অধিকারী, সাবড়াকোন, বাঁকুড়া

দরিদ্রের বড়দিন

প্রতি বছরের মতো এ বারও ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকেই আমেরিকার বিভিন্ন শহর সেজে উঠেছিল ক্রিসমাসের নানা সজ্জায় ও আলোতে। এই সময় প্রতিটি শহরের প্রাণকেন্দ্র বা ডাউনটাউন ঝলমলে আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। সন্ধে হতেই নানা গির্জা থেকে ভেসে আসে ক্রিসমাস ক্যারল। এখানে শহরের মাঝ বরাবর অনেক ক্রিসমাস ট্রি-র উচ্চতা প্রায় চার-পাঁচতলা বাড়ির সমান। অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষজনদের কাছেও উৎসবের সময় এটা। সবাই সবাইকে এই সময়ে নানা উপহারও দিয়ে থাকেন।

কিন্তু এই আলোর নীচেই আছে অন্ধকার। অনেকেই হয়তো জানেন না, সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকায় দারিদ্র ২০২৩ সালে ছিল প্রায় ১১.১%। এখানে প্রচুর লোক এখনও গৃহহারা। অথচ, বছরের এই সময় এখানে তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের নীচে, তুষারপাত হয়। সেই প্রবল শীতে শহরের রাস্তার ধারে বা ভাঙা কোনও বাড়িতে গৃহহারারা দিন কাটান। শহরের রাস্তাঘাটে তাঁদের ভিক্ষা করতে দেখা যায়। বড়দিনের আনন্দ, আলো, উপহার কিছুই তাঁদের জন্য নয়। ২০২১ সালে এই দারিদ্রের হার অনেকটাই কমে হয়েছিল প্রায় ৫.২%। এই রেকর্ড পরিমাণ হ্রাসের কারণ ‘চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট’-এ অস্থায়ী একটা ছাড় দেওয়া হয়েছিল। তার পর সেটা অনেকটা বেড়ে যায়। ভাবা যায় না আমেরিকাকে যে আমরা বড়লোকের দেশ বলে জানি, সেখানে একটা ছোট শিশু এক টুকরো পাউরুটির জন্য কী ভয়ঙ্কর প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ে।

ক্রিসমাসের সময় সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে অনেক সংস্থা থেকেই শিশুদের জন্য খাবার, খেলনা বিতরণ করা হয়। কিন্তু সমস্ত শিশুর জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা আর সারা বছর খাবারের জোগান। এর জন্য সরকারের পাশাপাশি চাই আরও সাহায্যের হাত। তা হলেই এই ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়তো কিছুটা দূর হবে।

সহেলি বন্দ্যোপাধ্যায়, আরকানসাস, আমেরিকা

Advertisement
আরও পড়ুন