জি২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
গত সপ্তাহে এই কলামে চলতি শতকের প্রথম ২৫ বছর সম্পর্কে কথা বলেছিলাম। এখন, নতুন শতকে যে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যদ্বাণীগুলি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তাদের প্রসঙ্গে আসার তাগিদ বোধ করছি।
বিশ্বের বিখ্যাত (কেউ কেউ বলেন ‘কুখ্যাত’) বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্কিং সংস্থা ‘গোল্ডম্যান স্যাক্স’ শতকের গোড়ার দিকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, চারটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বা ‘ব্রিকস’ (ব্রাজিল, রশিয়া, ভারত ও চিন) বৃদ্ধি পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত বিশ্বের ছ’টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বা ‘জি-৬’ (আমেরিকা, জাপান, জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইটালি)-এর সমকক্ষ হয়ে উঠবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অতিক্রম করে যাবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী বৃহত্তর পরিবর্তনের নিরিখে সফল হয়। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু ঘটে।
গোল্ডম্যান এ কথা বলেছিল যে, বৃহত্তর স্তরে ব্রিকস অর্থনীতিগুলি জি-৬’এর অর্থনীতির তুলনায় এক-সপ্তমাংশের অবস্থান থেকে বেড়ে ২০২৫ নাগাদ তাদের অর্ধাংশের সমতুল হয়ে উঠবে। আশ্চর্যজনক ভাবে, ব্রিকস এক দশক আগেই ২০১৫ সালে এই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলে। কিন্তু তার পর থেকে তাদের বৃদ্ধির গতিতে খানিক শ্লথতা দেখা দিয়েছে। ২০২৫ নাগাদ জি-৬’এর সম্মিলিত আকারের অর্থনীতির ৬০ শতাংশের সমকক্ষ ব্রিকস হয়ে উঠতে পারবে বলা হয়েছিল । মনে করা হয়েছিল, এই বৃদ্ধির বৃহদাংশই সম্ভব হবে ব্রিকসের দেশগুলির মুদ্রার মান বৃদ্ধির দ্বারা। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটেনি। তা সত্ত্বেও এ কথা বলা যায় যে, সার্বিক ভাবে ব্রিকস সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে অতিক্রম করে গিয়েছে।
এই অতিক্রমণের পিছনে সব চেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থেকেছে চিনের অসামান্য অগ্রগতির রেকর্ড। পাশাপাশি, ব্রাজিল এবং রাশিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশ হতাশ করেছে বলা যায়। ভবিষ্যদ্বাণী মানলে সাম্প্রতিক কালে রাশিয়ার ইটালিকে অতিক্রম করে গিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে অবস্থান করার কথা। কিন্তু বাস্তবে রাশিয়ার অর্থনীতি ইটালি ও ফ্রান্স— উভয়ের তুলনাতেই খাটো। ভারতই একমাত্র দেশ, যে ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লিখিত অবস্থার বেশ কাছাকাছি রয়েছে। ভারতের অর্থনীতিই ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লিখিত আকৃতির তিনগুণের বেশি হয়ে উঠেছে। ২০০০ সালে ভারতের অর্থনীতি ছিল জি-৬ দেশগুলির সম্মিলিত অর্থনীতির ২.৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা হয়ে দাঁড়ায় ৮.৫ শতাংশ। সঠিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখলে ৮.৪ শতাংশ। এই মুহূর্তে এ কথা মোটের উপর মেনে নেওয়া হয় যে, গত ২৫ বছরে সার্বিক ভাবে ব্রিকসের দিক থেকে যতটা না উন্নতি ঘটেছে, তার থেকে অনেক বেশি ঘটেছে শুধু মাত্র চিন ও ভারতের ক্ষেত্রে। এ কথাও ভেবে দেখার মতো যে, ২০২৫ সাল নাগাদ ভারতীয় অর্থনীতির চিনকে অতিক্রম করে যাওয়ার কথা। তা অনেকাংশেই যথার্থ বলে মনে হচ্ছে।
ব্রিকস অর্থনীতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে গোল্ডম্যান বিশেষ ভাবে ক্রিয়াশীল দেখিয়েছিল— বৃহত্তর অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে উন্মুক্ত মনোভাব, শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিকতা এবং উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। চারটি দেশের মধ্যে ভারত শুধু মাত্র অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেই সাফল্য লাভ করেনি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিচয়ও রেখেছে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে (সাম্প্রতিক কালে কিছু পিছু হটার ঘটনা বাদ দিলে) মোটের উপর উন্মুক্ত মনোভাব বজায় রাখতে এবং সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছে। যদিও এই সময়ে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে খানিক ক্ষয়ের লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তবুও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থা বেশ ভাল এবং সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতেও এই দেশ বেশ খানিকটা সফল। এই দুই ক্ষেত্রেই যথেষ্ট মাত্রায় উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ব্রাজিল বা রাশিয়া এ ধরনের সাফল্যের দাবিদার হতে পারে না। অন্য দিকে, চিন তার নিজস্ব সাফল্যের গতিকে অব্যাহত রেখে প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বীহীন অবস্থায় চলে গিয়েছে। ব্রিকসের মধ্যে হয়তো ভারত সব থেকে দরিদ্র দেশ। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের সম্ভাবনার দিক থেকে দেখলে তার অবস্থান বেশ আশাপ্রদ। এ কথা গোল্ডম্যান মনে করে।
চলতি শতকের দ্বিতীয়-চতুর্থাংশের দিকে তাকিয়ে এ কথা বলাই যায় যে, এমন পরিস্থিতি জারি থাকলে ভারতের উত্থান আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিভিন্ন রকমের অবরোধের বেড়া ডিঙিয়ে রাশিয়া বেশ পোক্ত অবস্থাতেই রয়েছে। কিন্তু তার নিজস্ব উৎপাদনের নিরিখে দেখলে সে গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে এ-ও সত্য যে, প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে তার সামনে যে নিষেধাজ্ঞাগুলি এই মুহূর্তে রয়েছে, তার জন্য তাকে দীর্ঘ মেয়াদে বেশ খানিকটা ভুগতে হতে পারে। ব্রাজিলের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং স্থবিরতা পর্যায়ক্রমে আসার এক পরম্পরা অনেক দিন ধরেই রয়েছে। চিন ক্রমেই পরিণতির দিকে এগোচ্ছে এবং তার বৃদ্ধির গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির নিরিখে চিনের অর্থনীতির গতিকে দ্রুততর রেখে চলতে হবে। ব্রিকস-এর চারটি দেশের মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিই সব থেকে দ্রুতগতিতে ঘটে চলেছে বলেই মনে হয়।
পরিশেষে: ১৯৯৭ সালে ‘বিজ়নেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার সম্পাদক থাকার সময় আমি এই কলাম শুরু করেছিলাম। আনন্দবাজার অনলাইনে সেই কলামেরই বঙ্গানুবাদ আপনারা প্রতি সপ্তাহে পড়েন। কলাম শুরুর পরে প্রায় ২৬ বছর কেটে গিয়েছে। ১,৩০০ নিবন্ধ লিখতে লিখতে আমি ৪৭ থেকে ৭৪ বছরে পৌঁছেছি। কিন্তু সক্রিয় সাংবাদিকতায় আমার সে ভাবে আর থাকা হয় না। ফলে প্রতি সপ্তাহে লেখার মতো বিষয় খোঁজা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। এ বার পাঠকদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এসেছে। এতদিন আপনারা মনোযোগ সহকারে এই কলাম পড়েছেন। তার জন্য অজস্র ধন্যবাদ।