প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
তাঁর প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ দিকে নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন যে তিনি ‘লুটিয়েন্স দিল্লি’র দখল নিতে পারেননি। সেটা তাঁর একান্ত আক্ষেপের বিষয়। ‘লুটিয়েন্স দিল্লি’ বলতে কার্যত তিনি সেই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত অভিজাত (মূলত ইংরেজিভাষী) জনগোষ্ঠীর কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, ‘লুটিয়েন্স দিল্লি’ হল নয়াদিল্লির একটি বিশেষ এলাকা, যা ইংরেজ স্থপতি স্যর এডউইন লুটিয়েন্সের নামাঙ্কিত। ব্রিটিশ আমলে লুটিয়েন্সই শহরের এই অংশের বেশির ভাগ স্থাপত্যের নির্মাতা। তাঁর দ্বিতীয় দফার কার্যকালের শেষ দিকে এই বিশেষ জনগোষ্ঠী তথা প্রতিষ্ঠানকে তিনি জয় করতে না পারলেও তাকে স্থানান্তরিত করতে পেরেছেন বলা যায়। বিষয়টি নিছক রাজধানীর নাগরিক পুনর্বিন্যাসের প্রশ্ন নয়, এটি আসলে মোদীর তরফ থেকে জাতির পুনর্সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।
দিল্লির দিক থেকে দেখলে এই বিশেষ প্রচেষ্টাটিকে শহরের পুরনো অভিজাতদের বাসস্থান দখল ও ধ্বংসের চেষ্টা বলে মনে হতে পারে। নাগরিক সমাজের যে সব চিন্তাশীল সংগঠন নিজস্ব মতামতে অনড় ছিল, তাদের আর্থিক জোগানের সূত্রগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হয় অথবা সরকারের মতে চালিত জনগণের দ্বারা তাদের শূন্যস্থান পূরণ করা হয়। বাকিদের কার্যনির্বাহী সমিতি বা আলোচক গোষ্ঠীর মধ্যে সরকারের লোক নিতে বলা হয়। জিমখানা ক্লাবের (যে ক্লাবের সদস্যরা একান্ত ভাবেই প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের বংশধরদের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছিলেন) পরিচালন ক্ষমতা এখন সরকারের হাতে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে সেই সব উপাচার্যদের নিয়োগ করা হচ্ছে, যাঁরা সম্ভব হলে প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বদলে দেবেন। পাশাপাশি, উদারপন্থী শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নির্মিত অশোক বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘উদারপন্থা’র সীমাগুলি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্কুল স্তরের পাঠ্যপুস্তক নতুন করে লেখা হচ্ছে।আর এই আবহেই এক অস্থিরমতি টিভি চ্যানেল এক ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ ব্যবসায়ী কিনে ফেলেছেন।
কেউ ওজর তুলতেই পারেন যে, ‘লুটিয়েন্সের দিল্লি’ আক্রান্ত ‘ভারত’-এর হাতে। তার রাষ্ট্রীয়করণ ঘটছে। তার পরেও কিন্তু এর মধ্যে ‘ইন্ডিয়া’-র প্রতাপান্বিত আদর্শকেই দেখা যায়। দিল্লির স্থাপত্য-মানচিত্রে বদল এনে, নতুন আইনগুলির হিন্দি নাম রেখে, ধর্মনিরপেক্ষ পরিসরগুলিতে হিন্দু প্রতীক এবং ভাবধারার প্রবেশের মাত্রা বাড়িয়ে সরকার এ কথা স্পষ্ট করে দিতে চাইছে যে, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের থেকে ভাষা ও ভাবগত ক্ষেত্রে পৃথক হওয়াই তার বাসনা। এর দ্বারাই সেই ‘নতুন ইন্ডিয়া’ গঠন সম্ভব, যার সাংস্কৃতিক শিকড় আগের চেয়েও অনেক গভীরে প্রোথিত। একটু ভুল হল।আসলে সরকার এক নতুন ‘ভারত’ গড়তে চাইছে। যদিও ‘ইন্ডিয়া’ আর ‘হিন্দু’—এই দুই শব্দকে ভিন্দেশে একই সূত্র থেকে উঠে আসা বলে মনে করা হয়। সে দিক থেকে দেখলে দেশের নামবদলের বিষয়টি নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তার অবকাশ রয়েছে।
বিষয়টি অবশ্য নাম বদল, জমানা বদল এবং আত্মপরিচয়ের রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে প্রসারিত। যেখানে ইউরোপীয় জ্ঞানদীপ্তি সর্বজনীন ভাবে স্বীকৃত ধারণার জন্ম দিয়েছে— এই ভাবনাটিই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ব্যক্তিস্বাধীনতা, সাম্য এবং আরও বড় করে দেখলে ‘মানুষের অধিকার’, অর্থাৎ যে সব ধারণার বীজ ফরাসি বিপ্লবের সময় অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং দেড়শো বছর পরে যা রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে’ উল্লিখিত হয়েছে, সেই সমস্ত কিছুই এখন চ্যালেঞ্জের সামনে। ভারতের সংবিধান মৌলিক অধিকারগুলির মধ্য দিয়ে জ্ঞানদীপ্তি-প্রসূত ভাবনাগুলিকেই প্রতিফলিত করে। কিন্তু রাশিয়ার কিছু চিন্তাবিদ (যাঁদের অন্যতম পুতিনের প্রিয়পাত্র আলেকজান্দ্র ডুগিন) এবং অন্যত্রও কেউ কেউ পশ্চিমি সর্বজনীনতাবাদের ধারণাকে গণমুখী জাতীয়তাবাদ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাকে সমষ্টিগত কল্যাণের ধারণা দিয়ে প্রতিহত করতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে এমন যুক্তির অবতারণা করা হচ্ছে যে, সর্বজনীনতার ধারণা আসলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তথা পার্থক্যের বিরোধিতা করে। পরিবর্তে উদারনীতিবাদই এই বৈচিত্র্যগুলিকে নিয়ে চলার একটা পন্থা দেখাতে সমর্থ।
সাংস্কৃতিক পার্থক্যের এই তত্ত্ব বহু ঐতিহ্যপন্থী অভিজাতের কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। যদিও এই অভিজাতমণ্ডলীর কেউই ইদানীং আর ‘এশীয় মূল্যবোধ’-এর প্রচার করেন না। আসলে সমস্যাটা এখানেই যে, সাংস্কৃতিক শিকড়ওয়ালা রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলি প্রায়শই নির্ভর করে দ্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তামিলনাড়ুর রাজনীতিবিদরা ‘সনাতন ধর্ম’-এর পরম্পরাগত স্তরবিভাজনকে আক্রমণ করেছেন। চিন আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনফুসিয়াসের বর্ণিত স্তরবিভাজনের মধ্যে থেকে উঠে আসা সম্প্রীতিকেই দেখতে চাইবে। তার আশপাশের ছোট দেশগুলি এমন স্তরবিভাজনের বিরুদ্ধে সরব হতেই পারে। ইতিমধ্যেই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ইতিহাস সম্পর্কে ভ্লাদিমির পুতিনের ধারণা, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয় নিয়ে তাঁর ভাবনার ফল স্পষ্ট ভাবে দেখা দিয়েছে। সাংস্কৃতিক শিকড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যবস্থাকে যদি কেউ সমস্যার সমাধানসূত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চান, তবে এর বিপজ্জনক দিকগুলি সম্পর্কেও তাঁকে সচেতন থাকতে হবে।
কেউ ইঙ্গেলহার্ট ও ওয়েজেলের তৈরি দু’টি অক্ষে বিভক্ত বিশ্বের সাংস্কৃতিক মানচিত্রের (আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রোনাল্ড ইঙ্গেলহার্ট এবং জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ওয়েজেল ওয়ার্ল্ড ভ্যালু সার্ভে এবং ইউরোপিয়ান ভ্যালু সার্ভের ভিত্তিতে বিশ্বের একটি সাংস্কৃতিক মানচিত্র তৈরি করেন। সেই মানচিত্রে মূলত বিশ্বাস আর মূল্যবোধের বিচারেই ‘ভ্যালু’র চরিত্র নির্ধারিত হয়েছিল। সেখানে তাঁরা দু’টি অক্ষের কথা বলেছিলেন) দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, ভারত ‘স্বাভাবিক’ পরিবর্তনের ধর্মনিরপেক্ষ-যুক্তিবাদী মূল্যবোধের বিষয়টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিপরীতের ‘সারভাইভাল ভ্যালু’র দিকে অর্থাৎ, শিকড়ের সংস্কৃতির অভিমুখে চালিত মূল্যবোধের দিকে ঢলে পড়ছে। ‘সেল্ফ এক্সপ্রেশন ভ্যালু’র (সামাজিক সহিষ্ণুতা, জনমতের বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদি) চেয়ে যা চরিত্রগত ভাবে আলাদা। এই বিশ্লেষণী কাঠামো দিয়েই বোঝা সম্ভব যে, মোদীর সরকারের সাংস্কৃতিক ধাক্কা আসলে তাঁদেরই একত্র করতে চাইছে, যাঁরা স্বঘোষিত ‘এলিট’ বা অভিজাত নন। কিন্তু ভারত এমনই একটি দেশ, যা কোনও দিনই বৈপরীত্য থেকে মুক্তি পাবে না। ২০১৭-র এক সমীক্ষার ভিত্তিতে রচিত পিউ রিসার্চ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যখন এক বিপুল সংখ্যক ভারতীয় গণতন্ত্রে আস্থা রাখছেন, ঠিক তখনই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বৈরতন্ত্র, বলবানের শাসন, এমনকি সামরিক শাসনকেও সমর্থন করছেন। সুতরাং, যখন মোদীর মতো এক বলবান নেতা ভারতকে ‘যাবতীয় গণতন্ত্রের জননী’ বলে অভিহিত করছেন, তখন সব কিছু এক্কেবারে ঠিক আছে বলা ছাড়া উপায়ান্তর নেই!