নভেম্বরের গোড়ায় কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করল যে, পেট্রল ও ডিজ়েলের উৎপাদন শুল্কের উপর যথাক্রমে পাঁচ ও দশ টাকা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এই ঘোষণাতেই সরকার ব্যাখ্যা করল, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম গত কয়েক মাসে অত্যন্ত চড়া, ফলে দেশেও পেট্রল-ডিজ়েলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এ দিকে, ডিজ়েলের দাম বাড়ায় দেশে মূল্যস্ফীতির হারও ঊর্ধ্বগামী হয়েছে। সরকার আরও জানাল যে, গোটা দুনিয়া জুড়েই সব রকম জ্বালানির জোগানে ঘাটতি পড়েছে, ফলে দামও চড়েছে। ভারতের বাজারে তার প্রভাবও পড়ছে। কিন্তু, সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে কথাটা বলল কেন্দ্রীয় সরকার, সেটি রাজ্য সরকারগুলির উদ্দেশে— কেন্দ্র যেমন ভাবে তেলের উপর শুল্ক কমিয়েছে, ঠিক সে ভাবেই রাজ্যগুলিও ভ্যালু-অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) বা যুক্তমূল্য কর কমিয়ে গ্রাহকদের রেহাই দিক।
সত্যিই রাজ্যগুলির পক্ষে যুক্তমূল্য করে ছাড় দেওয়া সম্ভব কি না, সেই আলোচনায় ঢোকার আগে এক বার দেখে নেওয়া ভাল যে, তেলের মূল্যবৃদ্ধির যে কারণ কেন্দ্রীয় সরকার খাড়া করেছে, সেগুলোই প্রকৃত কারণ কি না।
কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকের পেট্রোলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস সেল-এর দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, ২০২০ সালের মার্চ অবধি ভারতে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম ওঠানামা করেছিল আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই। কিন্তু, তার পর থেকে অপরিশোধিত তেলের দামের প্রভাব দেশের বাজারে খুব একটা পড়েনি। ২০২০ সালের মার্চে গোটা দুনিয়া যখন অতিমারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত, অর্থব্যবস্থা থমকে গিয়েছে সর্বত্র, তখন অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় তলানিতে নেমে এসেছিল। ভারতের বাজারে কিন্তু দাম বেড়েই চলেছে। তার কারণ, এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রল ও ডিজ়েলের উপর উৎপাদন শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়েছিল। ২০১৯-এর জুলাইয়ে পেট্রল ও ডিজ়েল, দুই জ্বালানির উপরই উৎপাদন শুল্ক ছিল লিটারে ১৯ টাকা ৯৮ পয়সা। কেন্দ্রীয় সরকার মার্চ মাসে তা বাড়াল দু’টাকা, মে মাসে সটান দশ টাকা। ফলে, ক্রেতার উপর উৎপাদন শুল্কের বোঝা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল লিটারে ৩৩ টাকার কাছাকাছি। খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে ভারত যে অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছিল, তার লিটারপ্রতি দাম ২৯ টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল ১৯ টাকার সামান্য বেশি। কিন্তু এই একই সময়কালে কলকাতায় পেট্রলের দাম ৭৭ টাকা লিটার থেকে বেড়ে হল ৮২ টাকা। এখান থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দামের সঙ্গে ভারতের বাজারে পেট্রল-ডিজ়েলের দামের আনুপাতিক ফারাক বাড়তে থাকে। তার পর সরকার তেলের উপর যখনই কর বাড়িয়েছে, এই ফারাকও বেড়েছে। কাজেই, কেন্দ্রীয় সরকার যদি বলে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার জন্যই ভারতে তেলের এমন মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, তার যুক্তি বোঝা মুশকিল।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে যুক্তমূল্য করে ছাড় দিয়ে গ্রাহকদের রেহাই দিতে বলেছে। যেখানে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মতেই দেশে রাজস্ব আদায়ে ভাটা পড়েছে, রাজ্যগুলির হাতে টাকার অভাবে রাজস্ব এবং মূলধনী, দুই খাতেই ব্যয়ে কাটছাঁট করতে হচ্ছে, সেখানে রাজ্যগুলিকে কর ছাড় দিতে বলাটা কি আদৌ নৈতিক?
২০১৭ সালের জুলাই মাসে জিএসটি চালু হওয়ার পর অধিকাংশ রাজ্যেই আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়েছে, কারণ তাদের নিজস্ব রাজস্বের পরিমাণ কমেছে— ব্যয় নির্বাহের জন্য তা আর যথেষ্ট নয়। যাকে স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম কর সংস্কার বলা হয়ে থাকে, সেই জিএসটি চালু করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু, তার জন্য রাজ্যগুলির সম্মতি আদায় করতে হয়েছিল। সেই সম্মতির গোড়ায় ছিল একটি প্রতিশ্রুতি— কর ব্যবস্থার সংস্কারের ফলে রাজ্যগুলি যে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবে, কেন্দ্রীয় সরকার সেই ঘাটতি পুষিয়ে দেবে। কিন্তু, জিএসটি ব্যবস্থায় শুরু থেকেই দুটো সমস্যা থেকে গিয়েছে। এক, যে ভাবে কর রাজস্বের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল (২০১৫-১৬ সালের স্তরের উপর চক্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ হারে), সেটা বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ এই কর সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গেই অর্থনীতির গতিভঙ্গ হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, জিএসটি চালু হওয়ার ফলে রাজ্যগুলির যে রাজস্ব ক্ষতি হবে, তা পুষিয়ে দেওয়ার জন্য কেন্দ্র সেস-বাবদ আদায় করা অর্থ রাজ্যগুলিকে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা সময়ে পূরণ করতেও কেন্দ্রীয় সরকার ব্যর্থ হয়েছে। জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সংসদে জানায় যে, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে জিএসটি ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্যগুলির পাওনা টাকার মধ্যে ৮১,১৭৯ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। অথচ, তার আগে ইঙ্গিত ছিল যে, সরকার রাজ্যগুলির প্রাপ্য টাকা চলতি অর্থবর্ষেই মিটিয়ে দিতে পারবে।
জিএসটি-তে আরও একটি নিয়মভঙ্গের কথা উল্লেখ করেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি), তার ২০১৯ ও ২০২০ অর্থবর্ষের রিপোর্টে। এই দু’বছরে “কেন্দ্রীয় সরকার আইজিএসটি অ্যাকাউন্ট থেকে ২৩,০০০ কোটি টাকারও বেশি নিজেদের কাছে রেখে দেয়, যা আইজিএসটি আইন-বিরোধী। আইন অনুসারে আইজিএসটি বাবদ আদায় করা রাজস্ব কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ভাগ করে নিতে হবে।”
ভারতের সংবিধান অনুসারে, সেস এবং সারচার্জ বাদে দেশের ডিভিজ়িব্ল পুল অব ট্যাক্সেস বা বণ্টনযোগ্য কর ভান্ডারে যে রাজস্ব জমা পড়বে, তা রাজ্যগুলির সঙ্গে ভাগ করে নিতেই হবে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২০-২১ অর্থবর্ষের জন্য তার সুপারিশে চতুর্দশ অর্থ কমিশন বণ্টনযোগ্য কর ভান্ডারে জমা হওয়া রাজস্বের ৪২ শতাংশ রাজ্যগুলিকে দেওয়ার কথা বলে— সিদ্ধান্তটি আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনও গত বছর তার সুপারিশ জমা দেওয়ার সময় এই সিদ্ধান্তটি অপরিবর্তিত রেখেছে।
সমস্যা হল, অর্থ কমিশনের সুপারিশের কোনও প্রতিফলন কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব বণ্টননীতিতে ঘটেনি। কথাটা কতখানি সত্য, তা বোঝার জন্য একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট— ২০১৯-২০ সাল থেকে কেন্দ্রীয় বণ্টনযোগ্য রাজস্ব ভান্ডার থেকে রাজ্যগুলির জন্য বরাদ্দের পরিমাণ সমানেই কমছে। তার চেয়েও বড় কথা হল, বণ্টনযোগ্য রাজস্ব ভান্ডারটির আয়তনই ক্রমহ্রাসমান, কারণ কেন্দ্রীয় সরকার রাজস্ব আদায়ের জন্য ক্রমশ সেস ও সারচার্জের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েই চলেছে। ২০১২-১৩ সালে কেন্দ্রের মোট কর রাজস্বের মাত্র নয় শতাংশেরও কম ছিল সেস ও সারচার্জ— ২০১৮-১৯ সালে সেই অনুপাতটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশের উপরে। ২০২০-২১ সালে তা আরও বেশি, ২০ শতাংশের অধিক। অর্থাৎ, যে বাটি থেকে রাজ্যগুলির জন্য ভাগ হবে, কেন্দ্রীয় সরকার সেই বাটির আয়তনটি ক্রমেই ছোট করে চলেছে।
কেন্দ্রীয় সরকার যে শুধু ইচ্ছামতো সেস আর সারচার্জ বসিয়ে চলেছে, তা-ই নয়, রাজ্যগুলি পেট্রোলিয়াম পণ্যের উপর যে হারে রাজস্ব আদায় করে থাকে, কেন্দ্রীয় রাজস্বের পরিমাণ তার তুলনাতেও অনেক বেশি। ২০১৪-১৫ সালে রাজ্য সরকারগুলি পেট্রোলিয়াম পণ্যের উপর আদায় করা রাজস্ব বাবদ আয় করেছিল মোট ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা; ২০২০-২১ সালে সেই অঙ্কটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.২ লক্ষ কোটি টাকায়— অর্থাৎ, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। এই একই সময়কালে পেট্রোপণ্যের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ বেড়েছে ২০০ শতাংশের বেশি— ১.৩ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ৪.২ লক্ষ কোটি টাকা।
কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতার মধ্যে যখন এমন আকাশ-পাতাল ফারাক, তখন কি এটা নিয়ে কোনও সংশয় থাকতে পারে যে, পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম কমানোর জন্য রাজস্ব কমাতে হলে সেই দায়িত্বটি কার উপর বর্তায়?
অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়