কলকাতার মঞ্চে গ্রিপস থিয়েটারে এ কালের রাজনীতির ছবি
Grips Theatre

ছোটদের সত্যি বলো

ছোট, বড় সবাই মিলে এ ভাবে নাটক তৈরি জার্মানির অবদান। এর নাম গ্রিপস থিয়েটার। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ১৯৬৬ সালের বার্লিনে ভোলকার লুডউইগের হাত ধরে এই নাটকের শুরু, তার পর দুনিয়াব্যাপী জয়যাত্রা।

Advertisement
গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৩০
কুশীলব: হাসি মজা সংলাপে শিল্পসম্মত প্রতিবাদ।

কুশীলব: হাসি মজা সংলাপে শিল্পসম্মত প্রতিবাদ। ছবি সৌজন্য: চেতনা নাট্যগোষ্ঠী।

ছোট্ট আলিবাবা ডাকাতদের গুহা থেকে ফিরে হতাশ। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে বড় গাধাটাকে ডাকে, “এই গাধা, তুই বললি, আরব্য রজনী পড়েছিস। গুহার ভেতর সোনাদানা, আমরা বড়লোক হয়ে যাব।” গাধা মাথা চুলকায়, “হ্যাঁ, তাই। গুগল করো।” আলিবাবা বলে, “তা হলে বস্তায় এ সব কী? আমার কান্না পাচ্ছে।”

Advertisement

কান্না পাওয়া স্বাভাবিক। বস্তায় ছেঁড়াখোঁড়া একটা চটি বই, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। ১০০ গ্রাম পোস্ত, একটা ভাঙা অ্যান্টেনা, আর একটা পুরনো টেলিফোন। ছোট্ট আলিবাবা জানে না, ওই ছেঁড়া বই এক দুর্মূল্য রত্ন। বড় হলে ক্রমে ওই বই যে তাকে সার্ত্র, গ্রামশি, আলথুজ়ার এবং আরও কত অচেনা রত্নভান্ডারে পৌঁছে দেবে। আর গাধাটাও তেমন! যেন হিমেনেথের কবিতার দার্শনিক গাধা। সে জানে, এই সভ্যতায় আলিবাবা মোটেও ছাপানো বইয়ে আরব্য রজনী পড়বে না। গুগল করে দেখে নেবে।

ছোট্ট আলিবাবার কি একটাই সমস্যা? এক দুষ্টু জাদুকরের হাত ঘুরে আলাদিনের জাদুপ্রদীপটা এসে গেছে তাদের বাড়িতে। মর্জিনা বয়সে বড়, ব্যাপারটা আঁচ করে সে প্রদীপটা লুকিয়ে রেখেছে। জাদুকর হুমকি দেয়, “তোমাদের ছবি তুলে কাগজে ছাপাব, বড় বড় হেডিং হবে, অন্যের সম্পত্তি, একটা পুরনো প্রদীপ চুরি করে টাকা লুট করল আলিবাবা ও তার পরিবার। তার পর সিবিআই, ইডি, এফবিআই সব একাকার।” আলিবাবার হতচকিত প্রশ্ন, “এই বয়সে এবিসিডিইএফ বলছে কেন?” তরুণী মর্জিনা সেই খুদেকে জানায়, “এটা বড়দের এবিসিডি।”

ছোট, বড় সবাই মিলে এ ভাবে নাটক তৈরি জার্মানির অবদান। এর নাম গ্রিপস থিয়েটার। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ১৯৬৬ সালের বার্লিনে ভোলকার লুডউইগের হাত ধরে এই নাটকের শুরু, তার পর দুনিয়াব্যাপী জয়যাত্রা। এই নাট্যরীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, ছোটদের সঙ্গে অভিনয় করলেও বড়রা মোটেও আধো আধো স্বরে আদিখ্যেতা করবে না। সকলেই সিরিয়াস। দর্শককে মাতাতে নাচগান অবশ্যই থাকবে, আর থাকবে হাল আমলের সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ। শিশুরা হাট্টিমাটিম টিম না আওড়ে এই জাতীয় আর্থ-সামাজিক ব্যঙ্গে থাকবে কেন, তা নিয়ে এক সময় প্রচুর আলোড়ন হয়েছিল। গোটাটাই কমিউনিস্ট বজ্জাতি বলে ভোলকারের নাটকে অর্থসাহায্যও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দুই জার্মানি একাকার হয়ে যাওয়ার পরও এই নাট্যপ্রকরণকে দমানো যায়নি। বরং ইউরোপের সীমানা ভেঙে কলকাতা থেকে কোরিয়া, নামিবিয়া সর্বত্র তার অবাধ যাতায়াত। এই নাটক দেখতে বসে বরং রুশ কবি ইয়েভতুশেঙ্কোর বিখ্যাত লাইন মনে পড়ে, “ছোটদের সত্যি কথা বলো, তারা সব জানে।”

কত দিন বাদে কলকাতা দেখল এই গ্রিপস থিয়েটার? আশির দশকে ম্যাক্সমুলার ভবনে মাঝে মাঝেই এই প্রকরণে সাড়া জাগাত অঞ্জন দত্তের আলিজীন বা জয়তী ঘোষের কেয়ার করি না। তার পর দেশ এগিয়েছে, এই বঙ্গে শিশু কিশোর আকাদেমি নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে। তারা ফি বছর স্কুলে স্কুলে নাটক শিখিয়ে ও লীলা মজুমদারের জন্মদিনে ‘বসে আঁকো’র ঢঙে বসে গল্প লেখো-র আয়োজন করে। কিন্তু শহরে ছোট-বড় সবাই মিলে রাজনৈতিক সচেতনতায় উদ্বুদ্ধ গ্রিপস থিয়েটার নামেনি। সেই আকাদেমির মাথায় এক জন বিশিষ্ট নাট্যপরিচালক থাকা সত্ত্বেও!

সবাইকে যে গ্রিপস থিয়েটার নামাতে হবে, এমন কথা নেই। আমাদের এখানে নাট্যদলগুলি আজও ইবসেনের পুতুলখেলা-র মোহে। এ দিকে গ্রিপস থিয়েটারের গোশ গার্লস নাটকে ছোট্ট মেয়েরা বিদ্রোহ করে। কেন তাদের আটকে থাকতে হবে শুধু রান্না, বাসন মাজা আর গৃহকর্মনিপুণা হওয়ার কাজে? এ দেশের জ্ঞানী নারীবাদীরা জার্মেন গ্রিয়ার, সিমোন দ্য বোভোয়া, অনেক কিছু জানেন, শুধু জানেন না ছোটদের কী ভাবে আনন্দের সঙ্গে এ সব বোঝাতে হয়। ওই থিয়েটারের আর এক বিখ্যাত নাটকে ছোট্ট মেয়ে মিলিপিলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে অজানা এক দ্বীপে চলে যায়। বড়দের অবহেলায় সেখানে সান্টা ক্লজ়ের ক্রিসমাস ট্রি শুকিয়ে গিয়েছে। তাকেই বাঁচাতে হবে সেই গাছ। বাস্তুতন্ত্র নিয়ে এর থেকে মোক্ষম রাজনৈতিক সত্য আর কী হতে পারে? ভোলকার অবশ্য সত্যের দার্শনিকতায় ঢোকেননি, তাঁর সাফ কথা ছিল, গ্রিপস মানে সাধারণ বুদ্ধি বা কমন সেন্স।

ওই বুদ্ধিটাই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গিগাবাইট, মেগাবাইটে অনুপস্থিত। বাবুরাম সাপুড়ের ‘সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনত’ লাইনটা এঁরা একদা কী ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ভেবেছিলেন, সে সব শঙ্খ ঘোষের এক নিবন্ধে আছে। কিন্তু একুশে আইনের খাপছাড়া নিয়মকানুন শিশুবেলার আবোলতাবোলে মনে গেঁথে যায় বলেই ভবিষ্যতে কবীর সুমনের গান থেকে হাল আমলের রাজনীতি, সব অনুষঙ্গেই সে মনে গেঁথে থাকে। এখানেই গ্রিপস থিয়েটারের সচেতনতার ভূয়োদর্শন। চেতনা-র নতুন নাটক হিবিজিবি বাহিনী-তে যেমন দেখা গেল, আরব্য রজনীর ডাকাতরা গুহায় ঢোকার ‘চিচিং ফাঁক’ বদলে শব্দ ও সংখ্যা সহযোগে পাসওয়ার্ড রেখেছিল ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর ১৯৪১।’ কিন্তু সেটিও হ্যাকাররা জেনে গিয়েছে। অগত্যা নতুন পাসওয়ার্ড ‘এপাং ওপাং ঝপাং, সবাই খেলো ড্যাং ড্যাং।’

গ্রিপস থিয়েটারের রাজনৈতিক চেতনা আরও ব্যাপ্ত, শুধু খোঁচাখুঁচিতে সে আবদ্ধ নয়। খুদে ডাকাতদের এক জন কালিয়া, অন্য জনের নাম আগে ছিল শ্যামাকেষ্ট, এখন ওসামাকেষ্ট। এক জনের নাম গদ্দাম হুসেন, অন্য জন রঘুবরণ। আরব্য রজনী-র পুরুষপ্রাধান্য ভেঙে খুদে মেয়েরাও আছে এই দলে। এক জন দেবী চৌধুরী, অন্য জন ঝুলন দেবী। তবে ডাকাতগুলি বেশ ক্যাবলা। ঘুড়ি, লাটাই আর ভীম নাগের সন্দেশ ছাড়া কিছুই লুট করতে পারে না। সর্দার সন্দেশ খেতে চাইলে সে গুড়ে বালি ঢেলে দেয়, “সর্দার, আপনার শুগার।” বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থার রাজ্যে এটাই তো আশার ঝলক। দেবী চৌধুরী ও ঝুলন দেবীদের ব্যুৎপত্তি এক দিন তারা ঠিক বুঝে যাবে। বাংলা সাহিত্য একদা প্রবল শক্তিমত্তায় এই সব মজা অক্লেশে করত। লীলা মজুমদারের বকবধ পালা-য় হিড়িম্বা শ্বশুরবাড়ি এসেছে। কুন্তী বলেন, “ও মা, হিড়িম্বা বউমা নাকি? তা বাছা, তোমার চেহারার এ কি হাল হয়েছে বলো দিকি। তখন তো দিব্যি ফুটফুটেটি ছিলে। এমনধারা পোড়া হাঁড়ি চেহারা কেমন করে হল গা?” খ্যানখ্যানে গলায় হিড়িম্বার পাল্টা উত্তর, “যাও তো ঠাকরুন, পুকুরপাড়ে এক বার গিয়ে জলের মধ্যে নিজের চেহারাটি দেখে এসো। মাছ, কচ্ছপরা সব আঁতকে উঠবে। আর আমাকে বলে কি না পোড়া হাঁড়ি।” তখন এক ভাবে মজা পেতাম। এখন অন্য ভাবে। রাক্ষসী টাইপ বৌমা আর রাজমাতা শাশুড়ির কথাবার্তা তো এ রকম ‘কিঁউকি সাসভি’ মার্কাই হবে।

এই নাটকের পলিটিক্স অবশ্য আজকের। সুকুমার রায় থেকে অঞ্জন দত্ত সবাইকে ট্রিবিউট দেয় সে। কাশেমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, গুহা থেকে ফেরেনি সে। মর্জিনা জিজ্ঞাসা করে, “কাক্কেশ্বর কুচকুচেকে খবর দিলে হয় না?” গাধা এই নাটকের সূত্রধর, সে বলে, “ভোটের আগে ওঁর ডেট পাওয়া যাচ্ছে না, সব চ্যানেলেই উনি।” গুহায় ঢোকার পাসওয়ার্ড হ্যাকড হয়েছে জেনে ডাকাত সর্দারের মন খারাপ। সে ভয়ে ভয়ে বলে, “আমি আবার ডাকাতকুলের কলঙ্ক হয়ে যাব, তখন আবার রামায়ণ লিখতে হবে। এই বয়সে আর পারব না, যা রামায়ণ চলছে চলুক, আমি ডাকু হয়েই মরতে চাই।”

আর গাধা? প্রতিটা রাজনৈতিক দল থেকে ভোটে দাঁড়ানোর ডাক তার কাছে। বন্ধু আলিবাবাকে সমর্থন করায় আলিবাবার বৌ নাক কুঁচকে বলে, “ইস। একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর।” শুনেই গাধা ঝটিতি বলে ফেলে, জয় শ্রীরাম। আলিবাবার বৌ আরও রেগে, “ইয়ার্কি হচ্ছে? যত দিন মা আছে, মাটি আছে, তোকে আমি মানুষ হতে দেব না, গাধা কোথাকার!” দেখতে দেখতে মনে পড়ল সত্তরের দশকে নির্মলেন্দু চৌধুরীর পুত্র, লোকগীতি-গায়ক উৎপলেন্দু চৌধুরীর বিখ্যাত গানের শেষ লাইন, ‘আর গাধা বলে, আমি দিল্লি গিয়ে ইয়ে হয়ে জনগণের সেবা করব।’ প্লাতেরো বা হিমেনেথের গাধা দার্শনিক, বাঙালির গাধারা বরাবর রাজনৈতিক!

শেষ দৃশ্যের রাজনৈতিক বয়ান আরও মারাত্মক! প্রদীপের জাদুকর আলাদিনের জিনকে বলে, “তোর লিবার্টি বের করছি। ক্ষমতার কাছে, টাকার কাছে সব লিবার্টি ভ্যানিশ। পরমাণু অস্ত্র হোক, ফেসবুক থেকে শালীনতা, ইনস্টাগ্রাম থেকে নন্দীগ্রাম সব কিনে নেব।” ডাকাতদলকে হামলা চালানোর ইশারা করে সে। কিন্তু কাসেম, আলিবাবারা এসে দেখে ডাকাতরা সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমের গ্যাস ছড়িয়েছে আলাদিনের জিন। C2+SUCI+HaCl+TmCh+C20+PyF5+ISF5+BJ2P+CP4M ফর্মুলায় তৈরি সেই পাউডার ছড়ালে দু’দিন ধরে নিশ্চিন্ত নিদ্রা। রাসায়নিক সূত্রের কপিরাইট নাট্যকারের, আমি চাক্ষিক মাত্র!

লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধের বাংলা মঞ্চে এই গ্রিপস থিয়েটারই কি নয় আজকের অন্যতম শিল্পসম্মত প্রতিবাদ? সমালোচক সি এস লুইস এক বার বলেছিলেন, সেটাই প্রকৃত শিশুসাহিত্য, যা সব বয়সে নতুন করে উপভোগ করা যায়। একদা এই শহরে সব পেয়েছির আসর, সিএলটি বা শিশুরঙ্গনের মতো ছোটদের নাট্যপ্রতিষ্ঠান ছিল, গুগাবাবা বা পদিপিসির বর্মিবাক্স-র মতো ছবি তৈরি হত। সব হারানোর রাজনৈতিক ভূমে এখন গ্রিপস থিয়েটারই হয়তো ছোট-বড় সবাইকে দেখাতে পারে নতুন আলো।

আরও পড়ুন
Advertisement