Teachers Day

বৃষ্টি হলে পড়ুয়াদের মাথায় জল পড়ে, তাই কষ্টে বাড়ি করছি, ওখানেই চলবে পাঠশালা

‘শিক্ষক দিবস’। একটা দিন বটে। বছরের অন্য পাঁচটা দিনের থেকে এই দিনটায় হয়ত শিক্ষকের উপস্থিতি বেশিই মালুম হয়।

Advertisement
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:২৮

নিজস্ব চিত্র

কোথায় রাখব এত স্মৃতি?

সেই কবে এসে জুটেছিলাম রামনগর হাইস্কুলে। তার পর কত দিন কেটেছে। অবসর এসেছে। এ শিক্ষক জন্ম ঘোচেনি তবু। শিক্ষকতা কী পেশা? না নেশা? জানি না। শুধু পেশা নয়, এটুকু জানি। তাই এত বসন্ত পেরিয়েও যখন হলুদ স্মৃতির পাতা উল্টে কোনও পড়ুয়া ফোন করে বলে, ‘‘মাস্টারমশাই, আপনি পদ্মশ্রী পাচ্ছেন! আমাদের খুব গর্ব হচ্ছে।’’ গলায় কথা সরে না।

Advertisement

কোথায় রাখব এত প্রাপ্তি?

মনে পড়ে, রামনগর হাইস্কুলে আদুড়িয়া গ্রামের একটি ছাত্র ভর্তি হয়েছিল। স্কুলে হস্টেল ছিল তখন। সেখানেই সে থাকত। নামও মনে আছে আমার, শ্রীধর লাহা। সেই সময়ে এক দিকে মাধ্যমিক, এক দিকে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পুরনো নিয়ম অনুযায়ী কিছু ছাত্র মাধ্যমিকে পরীক্ষা দিচ্ছে, আবার উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে সরাসরি উচ্চ-মাধ্যমিকও দিচ্ছে কিছু ছাত্র। শ্রীধর রামনগর হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়। তখন সরাসরি হায়ার সেকেন্ডারির দু’বছরের কোর্সে ভর্তি হওয়া যেত, আবার প্রি-ইউনিভার্সিটি পড়ে কলেজে ভর্তি হওয়াও যেত। হেতমপুর কলেজে প্রি-ইউনিভার্সিটিতে সে প্রথম হয়েছিল। আমার ছাত্র, প্রথম হয়েছে! প্রথম অভিজ্ঞতা আমারও। চোখ চিকচিক করে উঠেছিল। সত্যি এত আনন্দ আছে পৃথিবীতে?

কোথায় রাখব এত আনন্দ?

মাধ্যমিকে ফি-বছর ফল বেরোয়। ভাল-মন্দ লেগেই থাকে। কিন্তু আলো-অন্ধকারের মতোই আনন্দের ডাকে হয়ত আলগোছে এসে দাঁড়ায় দুঃখও। সাল-তারিখ এখন আর মনে নেই। একবার এক ছাত্র, মাধ্যমিকের পড়ুয়া, ফল ঘোষণার দিন শুনি, সে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। মৃত্যু! আমার ছাত্রের। ওই তো বয়স। স্যারের কথায় গাঁয়ের ছেলেটা রাত জেগে পড়েছে। প্রথম বিভাগে পাশও করেছে। কিন্তু কে পাশ করেছে? সে-ই তো নেই। পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার মুহূর্তেও সে যেন অশরীরী হয়ে আমার পায়ে হাত দিয়েছে মার্কশিট হাতে নিয়ে। আমি আশীর্বাদ করে বলেছি, ‘‘বড় হও।’’ একজন নয়, কালে কালে অনেক ছাত্রকেই দেখেছি, চলে যেতে। যে পথ তারা দিয়ে স্কুলে আসত, সে পথ খালি পড়ে থেকেছে। এসেছে নতুন পড়ুয়ারা। আমরা আবার দুঃখ চেপে আগলে নিয়েছি ওদের। আবার কখনও বড় হয়ে ওঠা ছাত্রের আচরণ দেখেও কষ্ট হয়েছে মনে। যেমন গাঁয়েরই এক ছাত্র, সে শিক্ষক হয়েছে। বড় হয়েছে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে। শহরের স্কুলে চাকরি পেয়েছে। কিন্তু গাঁয়েই ফেলে গিয়েছে অসুস্থ মা-বাবাকে। এমন শিক্ষা তো আমরা দিইনি বা দিতে চাইনি। কোথায় ভুল হল আমার? আমাদের?

কোথায় রাখব এত দুঃখ?

অবসর এসেছে। এ শিক্ষক জন্ম ঘোচেনি তবু। শিক্ষকতা কী পেশা? না নেশা? জানি না।

অবসর এসেছে। এ শিক্ষক জন্ম ঘোচেনি তবু। শিক্ষকতা কী পেশা? না নেশা? জানি না। নিজস্ব চিত্র

‘শিক্ষক দিবস’। একটা দিন বটে। বছরের অন্য পাঁচটা দিনের থেকে এই দিনটায় হয়ত শিক্ষকের উপস্থিতি বেশিই মালুম হয়। কিন্তু ছেলেমেয়েরা আজও যে বড় ভালবাসে। মাস্টারমশাইকে টিভিতে দেখলে যে ভাবে হোক নম্বর জোগাড় করে ফোন করে। খোঁজ নেয়— ‘‘স্যার ভাল আছেন?’’ হয়ত তারা অনেক বড় হয়েছে, চাকরি করছে, কেউকেটা হয়েছে। কিন্তু এখনও যে তারা শিশু, তা যেন ধরা পড়ে যায়। কী উচ্ছ্বাস! গাঁয়ের মাস্টারের নাম হচ্ছে, লোকে চিনছে, বাহবা দিচ্ছে, ওদের চোখ চকচক করছে। ‘‘আমার মাস্টারমশাই’’ বলে যেন সুখস্বর্গে মেঘের উড়ান দেয় ওই ছেলেমেয়েগুলো। ওদের জন্যই তো বেঁচে থাকা। ওদের জন্যই তো শিক্ষক দিবস। আমি মনে করি না শিক্ষকদের এখন আর কেউ সন্মান দেয় না। আলবাত দেয়, প্রতি পদে দেয়। ছাত্রছাত্রীরা আজও সমান কৃতজ্ঞ গুরুর প্রতি। আজও লাগামছাড়া ওদের ভালবাসা।

কোথায় রাখব এত ভালবাসা?

পড়ানো আমার হৃদযন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে। যত ক্ষণ শ্বাস, তত ক্ষণ ছাত্রছাত্রীরা থাকবে। এসে ঘরে বসবে। জিজ্ঞাসা করবে অনেক প্রশ্ন। ভুল করলে বকা খাবে। আবার ভাল ফল করলে আশীর্বাদের হাত উঠবে নিজেই। ওরা না থাকলে আমি কোথায় যাব? শুরু থেকেই এই সার কথাটা বুঝে গিয়েছিলেন আমার স্ত্রী। এই যে আমি বিনা পয়সায় পাঠশালা চালাই, কোনওদিন আপত্তি করেননি। শিক্ষকতা করে গাড়ি-বাড়ি তো হয়নি আমার। যা হয়েছে, সে-ও একরকমের কুবেরের ধন। সারিসারি ছাত্র পাঠ পেয়েছে জীবনের। মনে হয় এ সব ওঁর ভাল লাগত। প্রাণ ভরে যেত ওঁর। তাই আমাকে আজীবন সঙ্গ দিয়েছেন। এই ছোট্ট ঘর, একটা খাট, দু’ই আলমারি ঠাসা বই। বাড়ির লোক আমার কিছুই-না-থাকা জীবনের আসল থেকে যাওয়াগুলো চিনতে পেরেছে। তাই হয়ত এতদিন পরও আমি এখানে। আমার ভাই পোস্ট অফিসের চাকরি করত। অবসরের পর বাড়ির সামনের দালানে আমার মতোই ছাত্র পড়াতে শুরু করেছে। বিনা পয়সায়। প্রাথমিকের ছাত্ররা পড়ছে। কী আনন্দ হয় দেখলেই। ওঁরা যদি আমায় মাথায় তুলে না রাখত, পারতাম আমি?

কোথায় রাখব এত কৃতজ্ঞতা?

যে ঘরে বসে পড়াই, সেটা টিনের। এতদিনে সকলে জেনেই গিয়েছেন, আমার তেমন উপার্জন নেই।

যে ঘরে বসে পড়াই, সেটা টিনের। এতদিনে সকলে জেনেই গিয়েছেন, আমার তেমন উপার্জন নেই। নিজস্ব চিত্র

যে ঘরে বসে পড়াই, সেটা টিনের। এতদিনে সকলে জেনেই গিয়েছেন, আমার তেমন উপার্জন নেই। প্রাইভেট পড়িয়ে উপার্জন করতে চাই না। কিন্তু মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। পড়ানোর ঘরে পাকা ছাদ নেই। টিনের চালে ফুটো। ওরা যখন পড়তে আসে, তখন বৃষ্টি হলে ভারী অসুবিধা হয়। জল পড়ে। তাই আমি, আমার পরিবারের সবাই মিলে একটা পাকাবাড়ি তুলছি। ওদের পড়াতে হবে তো! জল পড়লে বইখাতা ভিজে যাবে। কী করে ক্লাস চলবে। ওটা হলে ওখানেই চলবে ‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’। ওরা পড়তে পারবে নির্বিঘ্নে। বেশ কিছুটা কাজ হয়েছে, বাকি আছে কিছুটা। হয়ে যাবে আর কয়েকদিনের মধ্যেই। আমার স্বপ্ন ওদের ওই বাড়িতে পড়াব। শিক্ষক দিবসে জানলার পাশে এসে সেই স্বপ্নটাই যে টোকা মারছে। এই মাস্টারিজীবনের সায়াহ্নেও।

কোথায় রাখব এত স্বপ্ন?

(লেখক পদ্মশ্রী প্রাপ্ত, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

Advertisement
আরও পড়ুন