বাঁ দিকে ওলাফ শোলৎজ়, ডান দিকে নরেন্দ্র মোদী। — ফাইল চিত্র। Sourced by the ABP
ভারতে এখন মোট জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশেরই বয়স ২৭ বছরের কম। বিশ্বের তরুণতম দেশের তালিকায় ভারত অগ্রগণ্য— জনসংখ্যার বহরের কথা ভাবলে, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অন্য দিকে, জার্মানিতে এখন জনসংখ্যার অর্ধেকই ৪৭ বছরের ঊর্ধ্বে। স্বাভাবিক ভাবেই, সে দেশে প্রশিক্ষিত কর্মক্ষম মানুষের চাহিদা বিপুল। সে চাহিদা মেটে অভিবাসনের পথে। সম্প্রতি জার্মানি ভারত থেকে দক্ষ কর্মী নিয়োগের বিষয়ে একটি কৌশলপত্র প্রকাশ করল। ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ভারত দ্বিতীয় দেশ যার বিষয়ে জার্মানি এমন নির্দিষ্ট কৌশলপত্র রচনা করেছে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ়-এর ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে। এই নীতি অনুসারে ভারতীয় কর্মীদের ভিসা ইত্যাদি পাওয়া সহজতর হবে। অন্য দিকে, তাঁদের জার্মান ভাষা শিক্ষারও ব্যবস্থা হবে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবাধ শ্রমশক্তির যাতায়াত বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থার সাফল্যের শ্রেষ্ঠ প্রতীক। ফলে, ভারতের শ্রমশক্তির প্রতি জার্মানির এই আগ্রহকে স্বাগত জানানোই বিধেয়। কৌশলপত্রটিতে প্রকাশিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, জার্মানিতে কর্মরত ভারতীয় শ্রমশক্তির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ নিযুক্ত এমন কাজে, যেখানে যথেষ্ট শিক্ষাগত ও কারিগরি দক্ষতা প্রয়োজন হয়। তাঁদের গড় আয়ও জার্মানিতে কর্মরত অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেকখানি বেশি। এই তথ্যগুলি ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গুণগত মানের অকাট্য প্রমাণপত্র। প্রধানমন্ত্রী যখন প্রশ্ন করেন যে, তাঁর শাসনকালের আগের বছরগুলিতে ভারতে কী হয়েছিল, তখন তিনি এই প্রমাণগুলির কথা মাথায় রাখতে পারেন।
মাথায় রাখার জন্য তাঁর অবশ্য অন্য বিষয়ও আছে। যেমন, এত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নামক প্রকল্পটি চালু করার পরও ভারতে উচ্চশিক্ষিত দক্ষ শ্রমশক্তি এত উদ্বৃত্ত কেন? জার্মানি যার সুবিধা নিতে চাইছে, সেটি ভারতের ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড— কয়েক বছর আগে অবধিও প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই যার কথা উল্লেখ করতেন। তরুণতম শ্রমশক্তি, প্রযুক্তিগত শিক্ষাও যথেষ্ট— এমন জনগোষ্ঠী দেশে থাকলে তা দ্রুত আর্থিক উন্নয়নের পক্ষে অতি সহায়ক হতে পারে, যদি যথেষ্ট লগ্নি আসে, যথেষ্ট উৎপাদনের পথে হাঁটতে পারে দেশ। দৃশ্যতই সেই সুযোগ ভারত কাজে লাগাতে পারেনি। প্রশ্ন হল, কেন? ভারতে শিল্প-উৎপাদনের ব্যয় উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেক কম। বিশেষত, বেতন। জার্মানি যে শ্রমশক্তিকে নিজেদের দেশে টানতে চাইছে, ঠিক সেই শ্রমশক্তিকেই ব্যবহার করে যদি তারা ভারতে উৎপাদন করত, তা হলে অনেক কম বেতনেই কর্মী নিয়োগ করা সম্ভব হত, ব্যয়ের পরিমাণ অনেক কমত। তবুও ভারতে তেমন বড় মাপের লগ্নি হয় না কেন? প্রধানমন্ত্রী যতই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ মর্মে আহ্বান করুন, আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি ভারতে আসে না কেন? স্বভাবতই এই প্রশ্নের কোনও একটি নির্দিষ্ট উত্তর নেই। তবে, বহুবিধ উত্তরের মধ্যে একটি উত্তর এটাও যে, লগ্নি ধাবিত হয় হাই ট্রাস্ট ইকনমি বা অধিক বিশ্বাসের অর্থব্যবস্থার দিকে। যে দেশে নাগরিকরা সরকারকে বিশ্বাস করে, নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতার পরিসর থাকে, এবং সরকার সমদর্শী হয়, লগ্নি সেই দেশকে বাছে। প্রধানমন্ত্রী ভেবে দেখতে পারেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারতের চেহারাটি এই রকম হল না কেন।