Schools of Tamluk

উপহারে লেখা ‘মনে রেখো’

এমনিতে আজকাল সাধারণ সরকার-পোষিত উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি আশা জাগায় না, বরং সর্বগ্রাসী হতাশাই ক্লান্ত করে। হাজারটা সমস্যা।

Advertisement
বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৪ ০৮:৫৫

যে  পথ দিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে নেমে পূর্ব মেদিনীপুরের বেতকল্লা মিলনী বিদ্যানিকেতনে যেতে হয় সেটি রাজপথ নয়, আবার পায়ে চলা পথও বলা যাবে না। পরিচ্ছন্ন ঢালাই রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি দু’টি গাড়ি চলার উপায় নেই— মুখোমুখি হলে চালক দু’জনকে নমনীয় ভঙ্গিতে আগুপিছু করে যেখানে একটু অতিরিক্ত জায়গা রয়েছে কিংবা অন্য দিকে যাওয়ার ঢালাই রাস্তা আছে সেখানে পাশ কাটাতে হবে। ‘আমি প্রথমে যাব’ এমন অহমিকা নয়, সামঞ্জস্যময় নমনীয়তা জরুরি। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির সামনে অবশ্য প্রশস্ত মাঠ আছে। পড়ুয়াদের খেলাধুলার জায়গার অভাব হয় না।

Advertisement

এমনিতে আজকাল সাধারণ সরকার-পোষিত উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি আশা জাগায় না, বরং সর্বগ্রাসী হতাশাই ক্লান্ত করে। হাজারটা সমস্যা। পড়ুয়া আছে অথচ নিয়মিত পূর্ণ-সময়ের শিক্ষকের অভাব, শিক্ষক আছেন ছাত্রছাত্রী নেই, বিজ্ঞান পড়ানোর পরিকাঠামো নেই বলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান পড়ানো অসম্ভব, স্কুলে আসা পড়ুয়াদের স্কুল সম্বন্ধে কোনও ভালবাসা গড়ে ওঠেনি, নিজেদের অবস্থা সম্বন্ধে প্রত্যয় ও আত্মমর্যাদা বোধের অভাব, এ রকম কতশত কারণ হতাশাকে ক্রমাগত পাক-খাওয়া দূষিত ধোঁয়ার মতো কালো, ঘন করে তুলছে। সমস্যাগুলি বস্তুগত, সেই সূত্রে মনোগতও বটে। বস্তুগত অভাব আমাদের মনকে বিষণ্ণ করে। অভাব পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও পরিকাঠামো থাকলে হয়তো হতাশা কিছু কমত। তবে প্রয়োজনের সামগ্রী ও পরিকাঠামোর অভাব অনেক সময় যত্ন, উদ্ভাবন ক্ষমতা, নমনীয় সদিচ্ছা দিয়ে যে দূর করা যায় তার প্রমাণ ইতিহাসে আছে। যেটুকু জমি রাস্তার জন্য পাওয়া গেছে তা দিয়ে যত্ন করে যাতায়াতের সুগম্য পরিচ্ছন্ন উপায় তৈরি করে নেওয়া তো যাক। যত্ন থেকে ভালবাসা, প্রত্যয়, আত্মমর্যাদাবোধ জেগে উঠতে পারে। জেগে ওঠে।

মিড-ডে মিলের ঘণ্টা পড়ে গিয়েছিল। সেই ঘণ্টা আনন্দের। পরিচ্ছন্ন বসার বেঞ্চিতে ছেলেমেয়েরা তাদের দ্বিপ্রাহরিক আহার সম্পন্ন করছিল। কোনও কোনও আয়োজন আমাদের তৎসম শব্দের মায়ায় নিয়ে যায়, তখন ‘মিড-ডে মিল’কে ‘দ্বিপ্রাহরিক আহার’ বলতে ইচ্ছে করে। প্রধান শিক্ষক তাপস কর বলছিলেন তাঁর প্রথম স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা। উলুবেড়িয়ার একটি স্কুলে তাঁর প্রথম চাকরি। গত শতকের আশির দশক। বিদ্যালয়টি সম্পন্ন, পরিকাঠামো যথাযথ— শৃঙ্খলার ইতিবাচক দিকটি চোখে পড়ত। সেখানেই মাস্টারমশাই হিসাবে তাঁর হাতেখড়ি: কেমন করে চালানো যেতে পারে একটি বিদ্যালয়, সেখানেই শিখেছেন। উলুবেড়িয়ার সেই স্কুলটি এখন শ্রী-সম্পন্নতা হারিয়েছে। তাপসবাবুর মন খারাপ, তবে বেতকল্লা মিলনী বিদ্যানিকেতনকে তিনি বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। এখানে প্রচুর ছেলে-মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান পড়ে এমন নয়। তবে যারা পড়ে তাদের প্রয়োজন মেটানোর মতো পরীক্ষাগার আছে। আর আছে একটি পাঠাগার ও প্রদর্শশালা। পাঠাগারটি অনেক দিনের যত্নে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা। পুঁজি সদিচ্ছা। স্কুল থেকে লেখকদের বাড়ি যাওয়া হয়েছিল, তাঁরা বই দিয়েছেন— নিজেদের, তাঁদের বাড়িতে থাকা অন্য বইপত্র। সেখানে চোখে পড়ল বেশ অনেক বই একঠাঁই করে রাখা— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যবহার করা বইয়ের মধ্যে বেশ কিছু ইস্কুলের পাঠাগারের জন্য বেছে পাঠিয়েছেন কবিপত্নী স্বাতী। ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা লাইব্রেরি ক্লাস রয়েছে। দৈনিক সংবাদপত্র থেকে কেটে রাখা হয় ভাল লেখা আর ছবি। এ রকম কাগজের বিষয়ভিত্তিক লেখা চিটিয়ে রাখার আলাদা-আলাদা অনেক খাতা। ছেলেমেয়েরা উল্টেপাল্টে দেখে খুশি হয়। প্রদর্শশালাটি এখনও জমে ওঠেনি, গড়ে উঠছেধীরে ধীরে।

লাইব্রেরির বাইরে আসতে চোখে পড়ল, দুপুরের খাওয়া শেষ করে ক্লাসে যাওয়ার আগে দোলনায় হাসিমুখে দোল খাচ্ছে কেউ কেউ। আনন্দ তাদের চোখেমুখে লেগে— স্বাভাবিক আনন্দ। জায়গা খুব বেশি নয়, তারই মধ্যে ভেষজ উদ্যান, সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা— রুচিশীল আচ্ছাদন মাথার উপর, মূল্যবান নয় তবে শ্রীময়। ভেষজ উদ্যানটি করোনার সময় দেখাশোনার অভাবে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এই স্কুলে মেধাবী ছাত্রছাত্রী— যাকে বলে ‘ব্রিলিয়ান্ট’— আসে না। কাছেই তাম্রলিপ্তে বেশ কয়েকটা ভাল স্কুল রয়েছে। তবে যাদের পাওয়া যায় তাদের শেখানোর চেষ্টা শিক্ষক-শিক্ষিকারা করেন। নিয়মিত পড়াশোনা হয়। অধিকাংশই খেটে-খাওয়া পরিবার থেকে আসা। বাড়িতে পড়ার পরিবেশ নেই। তবে সকলের চেষ্টায় স্কুলছুট খুব একটা হয় না।

ছেলেমেয়েদের কাছে গেলে তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান না দেখলে চলে! কাজেই উঠে পড়তে হল মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে অনুষ্ঠানকক্ষে যাচ্ছে। মাস্টারমশাইদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভয়ের নয়, খুবই সহজ। একটি বাচ্চা মেয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল, “মাস্টারমশাই ভাল আছেন?” মাস্টারমশাইও হেসে উত্তর দিলেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য তৈরি করা গেছে বড় একটা ঘর। গড়ে তোলা গেছে শব্দ-প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা। নাচ-গান শেখানোর জন্য আলাদা দিদিমণি, মাস্টারমশাই আর কোথায় পাওয়া যাবে? বিভিন্ন বিষয়ের দিদিমণি আর মাস্টারমশাইরা নিজেদের উদ্যোগে নাচ-গান-আবৃত্তি শেখান। সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল থেকে মজাদার কবিতা শোনাল পড়ুয়ারা। দিদিমণির পাশে বসে গলা মেলাল গানে। পাশে দিদি থাকায় ভরসার অভাব হয়নি। অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল নাচ— দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে সেই নাচের অনুষ্ঠানে চমৎকার একটি ছবি চোখে পড়ল। প্রথমে নৃত্য পরিবেশন করছিল যারা, তাদেরই এক জনের পায়ে আটকে যাচ্ছিল পরিধেয়। পরে সেই নৃত্যে যোগ দেবে যারা, তারা বসে ছিল। তাদেরই এক জন নাচ চলার সময় নীরবে বন্ধুর পায়ে আটকে যাওয়া পরিধেয়ের অংশ ঠিক করে দিল। তার জন্য অবশ্য থামাতে হল না অনুষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানে পড়ছে সে, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতি বন্ধুদের প্রতি এক রকম টান থেকে এই সহযোগিতার জন্ম। কী বলব একে? জাতীয়তাবাদী আত্মঘোষণার দেখনদারিত্বের বাইরে এই নীরব সামাজিক সহযোগটুকুই তো ভরসা।

হেডমাস্টারমশাই লাইব্রেরি থেকে বাইরে আসার পর ছেলেমানুষি করে বলেছিলেন, “আপনার একটা ছবি তুলে দেব?” সুস্মিত নীরবতা দেখে বললেন, “ওইখানে।” দেখি বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তির পাশে বোধিবৃক্ষ ও বুদ্ধদেব। সেখানে দাঁড়াই। ছবি তুলে দিলেন লাজুক ভঙ্গিতে। বললেন, “আমি ভাল তুলতে পারি না।” ভাবলাম এমন ছেলেমানুষিটুকু থাক। এখন তো দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আত্মম্ভরি রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের নামে গ্যারান্টির কথা প্রচার করেন। প্রশাসনিক স্তরে নির্দেশ দেওয়া হয় অমুক মন্ত্রীর সঙ্গে ‘সেল্ফি জ়োন’ থাকা চাই। সেই সব প্রচারের বাইরে এই বোধিবৃক্ষ আর বুদ্ধদেব আরাম দিল— প্রাণের মনের। ঠিক তেমনই আরাম পেলাম সহযোগের দৃশ্যে। এই টানকে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব বলতে ইচ্ছে করল না, স্বাভাবিক স্বদেশপ্রীতি এখনও বিলুপ্ত হয়নি।

সময় বেশি নেই। তাম্রলিপ্ত বইমেলা চলছে। এই বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে যোগ দেবে। রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের সঙ্গে বেতকল্লা মিলনী বিদ্যানিকেতন যোগ দেবে। আসবে ডহরপুর তপসিলী হাইস্কুল। বইমেলা তো কেবল বই বিক্রির মাঠ নয়, আগামী পড়ুয়াদের সাংস্কৃতিক সংযোগেরও মাঠ। নিজের স্কুলের মেয়েদের এক দিদিমণি টোটোতে তুলছিলেন। তিনি দায়িত্বে, মেয়েদের নিয়ে যাওয়ার। সকলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সমস্যা আছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের চাকরির ক্ষেত্রটি তো আগের মতো নেই। স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতিজনিত বিপত্তির আঁচ গায়ে লাগছে। ছেলেমেয়েরা যখন স্কুল শেষে বলে কী নিয়ে পড়ব, তখন সুনিশ্চিত জবাব দেওয়া কঠিন। বিকেল পড়ে আসছিল। মাস্টারমশাই-দিদিমণিদের সঙ্গে আমাকেও যেতে হবে তাম্রলিপ্ত বইমেলায়। সেখানে সান্ত্বনাময়ী আর ডহরপুর তপসিলী হাইস্কুলের দুই ছাত্রী বলবে ‘মধুসূদনের রচনা আমরা এখনও কেন পড়ব?’ সে বিষয়ক কিছু কথা। শোনার মন তৈরি করে দিল এখানকার পড়ুয়াদের সাহচর্য। হাতে তাঁদের দেওয়া উপহার, নীচে লেখা ‘মনে রেখো’। মনে রাখি। মনে যে রাখতেই হবে। এখনও যা আছে, যেটুকু আছে, যে ভাবে আছে তা-ই ভরসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement