যে দিন সারা রাত অন্ধকার উঠোনে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা, আর ওর শাস্তি যাতে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয় তা দেখার জন্য বহাল হয়েছিল ওই মেয়েটারই পুঁচকে সন্তান, আত্মগ্লানিতে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু পারেনি। কারণ ওই সন্তান। পাহারা দিতে দিতে মাঝেমাঝেই এসে সে মায়ের চোখের জল মোছাচ্ছিল আর কানে কানে বলে চলেছিল, “এক পায়ে নয়, দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াও মাটিতে, আমি কাউকে বলব না।”
ওই সন্তানের জন্যই হয়তো মেয়েটা প্রতি দিন মরেও প্রতি দিন বেঁচে ওঠে। আর বেঁচে উঠে জীবনের দৈনন্দিনতায় ডুব দেয়। কত দিন সে কান্না দিয়ে ভাত মেখে খেয়েছে। অত্যাচার সহ্য করতে করতে এক দিন বাঁধ ভাঙে। মেয়ে ছুটল থানায়। কিন্তু অভিযোগ শোনার পরিবর্তে তাকেই চোখরাঙানি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল পুলিশ। মেয়েটা তবু নাছোড়। ওর দৈনন্দিন নির্যাতন এবং থানার অসহযোগিতার কথা জানিয়ে মানবাধিকার কমিশনে চিঠি দিল। এবং তার ভিত্তিতেই কমিশন তলব করল রিপোর্ট, ওই জেলার পুলিশ সুপারের কাছে। কখনও কখনও এ ধরনের ঘটনায় কমিশন নিজেই তার নিজস্ব ‘পুলিশ ইনভেস্টিগেশন উইং’-এর উপর তদন্তের ভার দেয়। এই উইং-এর মাথায় আছেন এক জন ‘অ্যাডিশনাল ডিজি’ পদমর্যাদার পুলিশ আধিকারিক।
মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতা অনেক, তবে অসীম নয়। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, যে কোনও ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেই প্রতিকারের পথ দেখাবে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। যখন সে প্রত্যাশা পূরণ হয় না, তখন জাগে হতাশা, ক্ষোভ। তাঁরা ওয়াকিবহাল নন যে, মানবাধিকার আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট করা রয়েছে এই কমিশনের কার্যাবলি। যেখানে বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যদি এক জন সরকারি কর্মচারী (পাবলিক সার্ভেন্ট) হন, তা হলেই কমিশন তাঁকে যথাযথ শাস্তি প্রদান করতে সক্ষম।
ধরা যাক, সরকারি হাসপাতালে বেড থাকা সত্ত্বেও এক মুমূর্ষু রোগী একটি বেড পেলেন না, কিংবা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। বা কোনও এক সরকারি কর্তব্যরত ডাক্তারের গাফিলতিতে রোগী ভুল চিকিৎসার শিকার হলেন। এ সব ক্ষেত্রে কমিশন যদি কোনও অভিযোগ পায় রোগী কিংবা রোগীর পরিবারের কাছ থেকে, তা হলে তৎক্ষণাৎ স্বাস্থ্য দফতর বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট তলব করে সেটা খতিয়ে দেখবে, এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির সুপারিশ করবে।
মানবাধিকার কমিশনের কাজের একটি বড় অংশ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার। গরিব, অসহায় মানুষের কাছে পুলিশ এখনও ভয়ের প্রতিমূর্তি। প্রায়ই শোনা যায়, কোনও অভিযোগ নিয়ে মানুষ থানায় পৌঁছলে, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে কেস ডায়েরি বা এফআইআর গ্রহণ করা তো দূরের কথা, পুলিশ রীতিমতো ভয় দেখিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করে দেয় থানা থেকে। এ সব ক্ষেত্রেও, নিগৃহীতের আবেদনের ভিত্তিতে কমিশন অভিযোগ গ্রহণ করে এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে রিপোর্ট তলব করে।
এ বার ফিরে যাওয়া যাক, নিত্যদিন মার-খাওয়া সেই মেয়েটির কথায়। তার অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশন যখন ওই থানার নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট তলব করল সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের কাছে, তখন রাতারাতি চিত্র পাল্টে গেল। সেই থানাই হয়ে উঠল অতি সক্রিয়। শুরু হল ছোটাছুটি। নিগৃহীত মেয়েটির কাছে পুলিশ রোজই তখন আসছে-যাচ্ছে, নির্যাতনের ঘটনা মন দিয়ে শুনছে, রিপোর্ট লিখছে।
এতে লাভ এটাই হল, মেয়েটিকে এত দিন নিঃসহায় ভেবে রোজ রোজ যারা ওকে অপরিসীম শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করত, তারা একটু সমঝে গেল। আর মেয়েটিও নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরল। এ ভাবেই মানবাধিকার কমিশন অত্যাচার, অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা হিসাবে কাজ করে থাকে।
এ ছাড়াও প্রতি দিনই খবরে প্রকাশ পায়, রাজ্যে ঘটে চলেছে কত অন্যায়, অবিচার, যার শিকার এক জন অসহায় মানুষ। মানবাধিকার কমিশন সেই সব খবরের ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা শুরু করে। রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যায়, বিগত তিন বছরে, কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কেস করেছে (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) ২০১৯ সালে ১৭১টি, ২০২০ সালে ২২৯টি, এবং ২০২১ সালে (এখনও পর্যন্ত) ১৪৮টি।
২০২০ সালে অতিমারির কবলে যখন রাজ্য জুড়ে লকডাউন ঘোষিত হল, অনেক পেশার মতো ক্ষতিগ্রস্ত হলেন রিকশাচালকরাও। তাঁদের দুর্দশার কথা জানিয়ে ৫ এপ্রিল ২০২০ সালে একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয় একটি খবর, যার ভিত্তিতে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে একটি তদন্ত শুরু করে। সুপারিশ করে, সরকার যেন প্রতি এলাকায় স্ট্যান্ডভিত্তিক রিকশাচালকদের সংখ্যা নির্ধারণ করে এবং তাঁদের খাদ্য সরবরাহ করে।
তা বলে মানবাধিকার রক্ষার দায় শুধু মানবাধিকার কমিশনের উপরেই ন্যস্ত, এমন তো নয়। মানবিকতার উন্মেষ হওয়া চাই প্রতিটি মানুষের চেতনায়, বিবেকে এবং নিজস্ব কাজে। তবেই না সে নিজের কিংবা পরের মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হবে! এক বৃদ্ধ সকাল আটটার পর গৃহহীন, রাস্তাই তাঁর ঠিকানা, আশায় থাকেন কখন ঘড়িতে রাত দশটা বাজবে, যখন তিনি শোয়ার জন্য আবার নিজের ঘরটাকে ফিরে পাবেন। এই নির্যাতনের শিকার তাঁকে হতে হয়েছে, কারণ বৃদ্ধ তাঁর বাড়িটাকে মেয়ে-জামাইয়ের নামে লিখে দেবেন না। এ ঘটনায় কি আমাদের সমবেত বিবেক ধাক্কা খায় না? কত ক্ষণ, কত বার মানবাধিকার কমিশন, পুলিশ, বা প্রশাসন গিয়ে তাঁকে আইনি আশ্রয় দেবে বা মানবাধিকার পাইয়ে দেবে? এর পরেও কি ওই বৃদ্ধের পরিবার ‘মানুষ’ বলে উত্তীর্ণ হবে?