সলিল চৌধুরী। —ফাইল চিত্র।
মুম্বইয়ের ফিল্মজগতের সঙ্গে তখনও সে ভাবে পরিচয় হয়নি আমার। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ দিক সেটা। দিনে মুম্বইয়ের একটি গ্যারাজে কাজ করি। ডায়েরিতে কবিতার মতো করে লিখে রাখি যাপন। রাতের তীব্র আকর্ষণ বম্বে ইয়ুথ কয়্যার, যেখানে গান বাঁধছেন সলিল চৌধুরী। ওই ইয়ুথ কয়্যারেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। পশ্চিমি কোরাল টেকনিক ব্যবহার করে ইয়ুথ কয়্যার তখন ভারতের বিভিন্ন ভাষায় গান তৈরি করছে। সেখানে যাঁরা গাইতেন তাঁরা সিনেমাতেও তখন গাইতে শুরু করেছেন। ইয়ুথ কয়্যারের অনুষ্ঠানগুলি বিনামূল্যে তাঁদের করতে হত, অথচ ফিল্মের জন্য রেকর্ডিং করলে অর্থের মুখ দেখা যেত। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই যা হয়, খুব বেশি দিন টিকে থাকল না বম্বে ইয়ুথ কয়্যার। তবে ওই কয়্যারের কারণেই সলিলদার সঙ্গে আলাপ, ঘনিষ্ঠতা, যা তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত অটুটই থেকে গেল।
ইয়ুথ কয়্যারকে নিয়ে সলিলদার গর্বের শেষ ছিল না, কারণ শেষ পর্যন্ত দেশের অন্য শহরগুলিতে এই উদ্যোগ ছড়িয়ে যায়। রুমা গুহঠাকুরতা ছিলেন বম্বে ইয়ুথ কয়্যারের অন্যতম চালিকাশক্তি। কিছু পরে কলকাতায় ইয়ুথ কয়্যার করেন যা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল।
সলিলদার কথা বলার প্রসঙ্গে একটি বিষয় বার বার উঠে আসে। তা হল আমার গোটা জীবনজোড়া বঙ্গযোগ। বিমল রায়ের বন্ধু দেবু সেন কবিতা পড়তেন। তিনি খোঁজ রাখতেন আমার সামান্য লেখালিখির। তিনিই এক দিন প্রস্তাব দিলেন সিনেমায় গান লেখার। নিজে যান বিমলদার কাছে। আলাপ হয় শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে। তারও বহু আগেই এই সংযোগ তৈরি হয়েছিল আমার বাল্যকালে। সে সময়ে থাকতাম পুরনো দিল্লির রোশনারা রোডে একটি ক্লক টাওয়ারের কাছে। তার উল্টো দিকের বইপত্রের দোকান থেকে হপ্তায় চার আনা দিয়ে বই ভাড়া করে এনে পড়তাম। তখনই হাতে আসে ১৯১৩ সালে ম্যাকমিলান লন্ডন প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি কবিতা সঙ্কলন দ্য গার্ডেনার-এর উর্দু অনুবাদ। রাতের ঘুম উড়ে যায় পড়তে পড়তে। রবীন্দ্রনাথে ডুবে যাওয়ার সেই শুরু। ওই স্টল থেকেই এর পর একে-একে পড়ি বঙ্কিমচন্দ্র এবং শরৎচন্দ্রের অনুবাদ।
ফলে, আজ মনে হয় সলিলদার সঙ্গে আলাপ, ঘনিষ্ঠতা, তাঁকে এত কাছ থেকে দেখার এবং কাজ করার সুযোগ আমার নিয়তি-নির্দিষ্ট ছিল। প্রেমপত্র এবং বন্দিনী ছবির জন্য আগে কাজ করলেও বিমল রায়ের কাবুলিওয়ালা-য় আমার লেখা গান প্রথম পর্দায় এসেছিল, মানুষে শুনেছিলেন, কারণ সেটা আগে রিলিজ় করে। কাবুলিওয়ালার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন সলিলদা। আমি তখন বিমলদার সহকারী হিসাবে কাজ করছি, উনি ছবির জন্য দু’টি গান আমাকে শোনান। একটি মান্না দের গাওয়া অবিস্মরণীয়, ‘অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়াতন, আয় মেরে বিছড়ে চমন...’; অন্যটি একটি ভজন। গান দু’টি লিখেছিলেন প্রেম ধওয়ন। সে যুগে কোনও ম্যাগনেটিক টেপ রেকর্ডার ছিল না, থিয়েটারে গিয়ে অপটিক্যাল ফিল্মে শুনতে হত। বিমলদা শোনানোর পর জানতে চাইলেন, ‘কেমন লাগল?’ বললাম, মান্না দে-র গাওয়া গানটি তো অপূর্ব, কিন্তু ভজনটি আমার একেবারেই সুবিধার লাগেনি। বিমলদা, জবাবে বললেন, ‘হুম’!
তাঁর এই ‘হুম’ তখন বেশ বিখ্যাত, যার অনেক অর্থ হত! এ ক্ষেত্রে কয়েকদিন পর বিমলদা আমাকে বললেন ভজনটি নতুন করে লিখতে। আমার তো মাথায় হাত। প্রেম ধওয়ন আমার ভাল বন্ধু, ভারতীয় গণনাট্য সংগঠনের সূত্রে পরিচয়। এ বার আমি কী করি! দৌড়লাম সলিলদার কাছে। তাঁকে গিয়ে বললাম, “এই ব্যাপার। আপনি কিছু একটা উপায় করুন। প্রেমকেই বলুন আবার লিখতে। প্রেম আমার বন্ধু, কী করে আমি তাঁর লেখা ভজন ফেলে দিয়ে নিজে লিখি?” সলিলদা ব্যাপারটাকে গুরুত্বই দিলেন না, বরং সহজ করে দিলেন। বুঝিয়ে বললেন যে, প্রেমই নাকি বিমলদার কাছে আমার নাম সুপারিশ করেছে। প্রেম এক জন অভিনেতাও বটে, তার তখন মুম্বই ছেড়ে আইপিটিএ-র একটি নাটক করতে যাওয়ার কথা। অগত্যা আমাকেই ছবির এই দ্বিতীয় গানটি লিখতে হল। ‘গঙ্গা আয়ে কাঁহা সে, গঙ্গা যায়ে কাঁহা রে... লহরে পানি মে য্যায়সে ধুপ ছাঁও রে’। এটি আমার লেখা হিন্দি ছবির জন্য দ্বিতীয় গান, এর আগের অর্থাৎ প্রথমটি ছিল ‘মেরা গোরা অঙ্গ লেই লে...’। আসামান্য সুর দিয়েছিলেন সলিলদা। আর গেয়েছিলেন অদ্বিতীয় হেমন্তকুমার। এই গানের রেকর্ডিংয়েই দীর্ঘদেহী মানুষটির সঙ্গে আমার আলাপ হয়। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, আমার লেখা রিলিজ় হওয়া প্রথম গানের সুরকার ছিলেন সলিল চৌধুরী এবং কণ্ঠ দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এও এক দুর্লভ বঙ্গযোগ।
সলিলদার কথা উঠলেই আমার মনে পড়ে বিমলদারই পরিচালনায় দো বিঘা জ়মিন ছবিটির কথা। সলিলদার লেখা ওই ছবি ভারতীয় সিনেমায় মাইলফলক তো বটেই, আজ এত বছর পরেও কত সমাসাময়িক। বহু কৃষক আমাদের দেশে এখনও সেই একই দুর্দশার মধ্যে। আমি নিশ্চিত যে, সলিলদা এই ছবির চিত্রনাট্য লেখার সময় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি থেকে। ছবির জন্য হয়তো অন্য ভাবে লিখেছিলেন, কিন্তু মূল উৎস ওটাই। ছবির সঙ্গে কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন মিলিয়ে দেখলেই তা বোঝা যাবে। “শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।/ বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।”/ কহিলাম আমি, “তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।/ চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।” এখান থেকেই ছবির চিত্রনাট্যের জন্ম দিয়েছিলেন গ্রেট সলিলদা।
সলিলদার কথায় আরও এক জিনিয়াসের কথা মনে পড়ছে, যিনি সলিলদার বন্ধুও বটে। ঘটনাটি মজার। একটা সময় অভিনেতা অভি ভট্টাচার্যের বাড়িতে আমরা মাঝেমাঝেই জমায়েত হতাম, পানভোজনের সঙ্গে আড্ডাও চলত। আমি যেতাম সলিলদার ছোটভাই বাবুর সঙ্গে। সেখানে নিয়মিত আসতেন ঋত্বিক ঘটক। অভি আর ঋত্বিকদা একটি নতুন ছবি পরিকল্পনা ফাঁদতেন পানের শুরুতে। কয়েক পেগের পর আসত বাজেট নিয়ে আলোচনা। এই ঘটনাটি রোজই ঘটত নিয়মিত ভাবে। এক রাতে ওই কাল্পনিক ছবির সুরকার কাকে করা হবে, তাই নিয়ে তর্ক চলছে দু’জনের মধ্যে! অভি বললেন, সলিলদার নাম। স্বাভাবিক, কারণ দু’জনেই কমরেড। হাঁই হাঁই করে উঠলেন ঋত্বিকদা। তাঁর প্রাণের বন্ধু সম্পর্কে বলে উঠলেন, “কী! সলিল মিউজ়িক দেবে? কোথায় মাল খেয়ে উল্টে পড়ে থাকবে!” আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, মনে মনে ভাবছি, ঋত্বিকদা এই কমেন্ট করছে! আর তার পর একটা বিরাট হাসির রোল উঠেছিল। আর সবাই মিলে তখন ঋত্বিকদার পিছনে লাগা হত। এই ঋত্বিক ঘটককেই বলতে শোনা গিয়েছিল সলিলদাকে, “ওরে সলিল! তোর মার্ক্সিস্ট বন্ধুকে একটা ভূতের গপ্পো বেচেছি!” বলা বাহুল্য, ছবির নাম মধুমতী, পরিচালনা করেছিলেন বিমল রায়।
কাবুলিওয়ালা ছবির কথা এবং সেই ছবির ভজনটিতে গান লেখার কথা গোড়াতেই বলেছি, সেই ছবি সংক্রান্ত সলিলদার একটা মজার ঘটনা বলি এ বার। কলকাতা গিয়েছিলাম একটা ছবি সংক্রান্ত কাজেই, সেখানে রাজেন তরফদারের রিলিজ় হওয়া গঙ্গা ছবিটি দেখে ফিরেছি মুম্বই। সেই ছবিতে শুনে মুগ্ধ হয়েছি সলিলদারই লেখা এবং সুর দেওয়া যুগান্তকারী গান, ‘আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে’। মুম্বই ফিরেই গিয়েছি তাঁর বাড়ি। গিয়ে দেখি, এক তলায় জমিয়ে টেবিল টেনিস খেলছেন। এখানে বলে রাখা ভাল, ক্যারম এবং টেবিল টেনিস খেলার সময় তাঁর কাছে গানের কথা, সুর, এ সব নিয়ে কিছু বলতে গেলে খুবই বিরক্ত হতেন— কোনও মতে হ্যাঁ হুঁ করে কাজ
সারতেন! তারই ফাঁকে সলিলদাকে জানাই, গঙ্গা ছবির গানটি দুর্দান্ত লেগেছে। বিমল রায়ের সঙ্গে যে কাজটি তখন চলছে (কাবুলিওয়ালা), সেখানে যে ভজন থাকবে, এই সুর ব্যবহার করলে ব্যাপারটা জমে যাবে। খেলা না থামিয়েই সলিলদা অন্যমনস্ক ভাবে বলেন, ঠিক, ঠিক ভাল আইডিয়া। এক কাজ করো, উপরের তলায় চলে যাও সোজা। পিয়ানো রয়েছে, সহকারী কানু রায়ও রয়েছেন। গানটা নিয়ে কাজ শুরু করো।
সবে উপরে উঠেছি কি উঠিনি, শুনছি বাড়ির দরজার কাছে বিমল রায়ের স্টেশন ওয়াগনের হর্ন! এ বার ঘটনা এক অপূর্ব কাণ্ড! সলিলদা খেলা ছেড়ে লাফ মেরে দোতলায় সটান পিয়ানোর সামনে, গভীর অভিনিবেশে! ওই সুরটুকুই বাজাচ্ছেন, চক্ষু মুদে, যেন সুরের মধ্যে ডুবে রয়েছেন! দু’মিনিট পরই বিমল রায় ঢুকে যে দৃশ্য দেখেন তাতে তাঁর এতটুকুও সন্দেহ হতে পারে না যে, এই লোকটাই পাঁচ মিনিট আগে টেনিস খেলছিলেন! কোনও মতে চোখ খুলে বিমল রায়কে সলিলদা বলেন, “দাদা এই ভজনটির সুর গঙ্গা-র গানের সুরেই দিলে কেমন হয়?” বিমলদা খুশি মনেই মাথা নেড়ে সামান্য কিছু তদারকি সেরে বেরিয়ে যাওয়ার পর, তাঁর গাড়ির আওয়াজ মেলানোর আগেই, লাফ দিয়ে নেমে এসে সলিলদা ফের টেবিল টেনিস বোর্ডে!
এই জিনিয়াসকে আমি এত কাছ থেকে দেখেছি, তাঁর স্নেহ ও প্রশ্রয় পেয়েছি, আমার কাছে এই সঞ্চয় অমূল্য।