সে বার নাশিকে পৌঁছে প্রথম দিন গেলাম দিন্দোরীতে। মহারাষ্ট্রের সহ্যাদ্রি পর্বতমালার কোলে চাষের জমি। আনাজ, বিশেষত পেঁয়াজ-টমেটোর চাষ। গোটা দেশে নাশিকের পেঁয়াজ-টমেটো যায়। বিদেশেও রফতানি হয়। সেখানেই দেখা সুখদেও যাদবের সঙ্গে। পৈতৃক জমিতে পেঁয়াজের চাষ। সরকারি মাণ্ডিতে না গিয়ে উত্তরপ্রদেশের এক ব্যবসায়ীকে পেঁয়াজ বেচেছিলেন। এক লক্ষ টাকা নগদ মিলেছিল। বাকি প্রায় দেড় লক্ষ টাকার চেক বাউন্স করে। তত দিনে ব্যবসায়ী পগার পার। সুখদেওর বাবা মাধো থানা-পঞ্চায়েতে ঘুরে ঘুরে বুঝেছিলেন, ও টাকা আর উদ্ধার হবে না। হতাশায় ডুবে গিয়ে মাধো গলায় কীটনাশক ঢেলেছিলেন।
২০১৯-এর ডিসেম্বরের কথা। তার এক বছর আগেই নাশিকের কৃষকরা মুম্বই পর্যন্ত পায়ে হেঁটেছেন। একশো আশি কিলোমিটারের ‘কিসান লং মার্চ’। পায়ের ছাল উঠে গেলেও কপাল ফেরেনি। নাশিকের লাসলগাঁওতে দেশের সবচেয়ে বড় পেঁয়াজের পাইকারি বাজার। সেখানে পেঁয়াজ বেচতে এসে চাষিরা কেজিতে দু’-এক টাকা দাম পাচ্ছেন। এ দিকে চাষের খরচ সাত-আট টাকা। কেউ পেঁয়াজ রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। আর কেউ দেনা শোধের চিন্তায় মাধো যাদবের রাস্তা বেছে নিচ্ছেন।
দিন্দোরীর পরের দিন লাসলগাঁওতেই যাওয়া ঠিক হল। লাসলগাঁও কৃষি পণ্য বাজার কমিটির কর্তা শিবনাথ যাদবও নিজের জমিতে পেঁয়াজ, আঙুরের চাষ করেন। কথা হল, তিনিই লাসলগাঁও বাজার ঘুরিয়ে দেখাবেন। চাষিদের সমস্যা বোঝাবেন। পরের দিন সকালে শিবনাথ এলেন সাদা রঙের এসইউভি চালিয়ে। বাজারে ওই গাড়ির দাম অন্তত ১৫ লক্ষ টাকা। আর পেঁয়াজের দাম? শিবনাথ হেসে জানালেন, তাঁর জমির পেঁয়াজ আগেই মুম্বই থেকে জাহাজে চেপে আরব রওনা হয়েছে। গ্রীষ্মকালে নাশিকে যে পেঁয়াজ ফলে, তার ঝাঁঝ ও খোশবাই আরবদের বাবুর্চিখানায় পৌঁছে যায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তাঁর তিন কৃষি আইনে মাধো যাদব-শিবনাথ যাদবদের ফারাক ঘুচে যাবে। চাষিরা যেখানে খুশি, যাকে খুশি ফসল বেচতে পারবেন। সরকারি বাজার কমিটি নিয়ন্ত্রিত মাণ্ডির ভরসায় থাকতে হবে না। মুম্বই-আমদাবাদের কর্পোরেট সংস্থা নাশিক বা নদিয়ার চাষির সঙ্গে চুক্তি করে ফসল কিনে নিতে পারবে। সকলের ঘরে লক্ষ্মী আসবে। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’।
মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফডণবীসের বিজেপি সরকার এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল। কৃষি পণ্য বাজার কমিটি আইনে রদবদল করে বলা হয়েছিল, ব্যবসায়ীরা যে কোনও চাষির থেকে ফসল কিনতে পারবেন। কোথাও নাম-ঠিকানা লেখানো, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স দেখানোর দরকার নেই। তারই ফল, উত্তরপ্রদেশের ব্যবসায়ীর কাছে ঠকে গিয়ে মাধো যাদবের অপমৃত্যু।
মোদী সরকার সব রাজ্যকে একই রকম রদবদল করতে বলেছিল। অনেক রাজ্যই কিছু কিছু রদবদল করেছিল। কেন্দ্রের পক্ষে ওই আইনে রদবদল করা সম্ভব ছিল না। কারণ সংবিধান অনুযায়ী কৃষি রাজ্যের বিষয়। হঠাৎ সে সব ভুলে গত বছর জুনে কেন্দ্রীয় সরকার তিন কৃষি অধ্যাদেশ জারি করে দিল। গোটা দেশে তখন লকডাউন। কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আলোচনায় যাননি। সংসদেও ওজর-আপত্তি কানে তোলেননি। আইনে বলা হল, প্যান কার্ড থাকলেই চলবে। তা হলেই যে কেউ লখনউ থেকে গিয়ে লাসলগাঁওয়ের পেঁয়াজ কিনে নিতে পারবেন।
সবাই নিজের ভাল বোঝেন। গ্রামের গরিব চাষিরাও। তাঁরা কৃষি আইন মানেননি। এক বছর দিল্লির সীমানায় আন্দোলন করেছেন। নরেন্দ্র মোদীও নিজের ভাল বোঝেন। তিনি কৃষি সংস্কারের আইন থেকে সরে এসেছেন। কারণ শিয়রে উত্তরপ্রদেশের ভোট। অতএব!
মাঝখান থেকে কৃষি সংস্কার স্বখাত সলিলে। এ দেশে কৃষিতে যে আমূল সংস্কার জরুরি, তাতে সবাই একমত। সরকার ঘটা করে ফসলের এমএসপি বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে। কিন্তু দেখা যায়, সরকার ১০০ টাকা দাম দিলে ১৮০ টাকা চাষেই খরচ হয়। অদ্ভুত ধাঁধা। সরকার ভর্তুকি দিল। চাষির লাভ হল না। বাজারে বেচতে গেলে আবার দেখা যায়, ওই ১০০ টাকাও মিলছে না। ফলে চাষিরও আয় বাড়ে না। ২০০২-০৩ থেকে ২০১৫-১৬, এই সময়কালে দেশে মাথা পিছু গড় আয় ৫ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। কিন্তু চাষি পরিবারের আয় বেড়েছে মাত্র ৩.৭ শতাংশ হারে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এক সময় চাষিদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার
স্বপ্ন দেখাতেন। এখন আর তা নিয়ে উচ্চবাচ্য শোনা যায় না।
সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কৃষি আইন পাশ করানোটা ভুল ছিল। তার থেকেও বড় ভুল, কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা না করে আইন তৈরি করা। সরকার কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসল ঠিকই। আইন তৈরির পরে। তত দিনে কৃষক নেতারা আইন প্রত্যাহারের গোঁ ধরে ফেলেছেন। তাঁদের কথামতো আইনের রদবদলেও রাজি হননি। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েই শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের পথ সহজ করতে আইন সংশোধনের চেষ্টা করেছিলেন। সে বারও একই ভুল হয়েছিল। আগেভাগে আলোচনায় যাননি। শেষে সরে আসতে হয়। তার পরে জিএসটি বাদ দিলে কৃষি আইনই ছিল তাঁর জমানায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রচেষ্টা। এ বারও ‘ইউ-টার্ন’।
সব রাজ্যেই ফসলের মাণ্ডিতে ব্যবসায়ী, মিডলম্যান বা কমিশন এজেন্ট, মহাজনদের দাপট। এঁদের মাথায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদের হাত। চাষিদের তাঁদের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হয়। এই ঘুঘুর বাসাটা ভাঙা দরকার ছিল। তা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী চাষিদের বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। কিন্তু আইনে চাষিদের হাতে ঢাল-তরোয়াল দিলেন না। এত দিনে চাষিরা মহাজন-ব্যবসায়ী-মিডলম্যানদের সঙ্গে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে শিখে গিয়েছেন। হাজার হলেও সবাই তো এক পাড়া গাঁয়ের লোক। কিন্তু মুম্বই-আমদাবাদের শিল্পপতিরা তো চাষিদের কাছে অচেনা। তাঁরা ঠকিয়ে দিলে আদালতে যাওয়ার উপায়ও আইনে রাখা হয়নি। চাষিরা তাই ভয় পেলেন। চুক্তিতে চাষ করতে গিয়ে ঠকে যাওয়ার ভয়। চুক্তিমতো ফসল ফলাতে না পারলে মোটা জরিমানার ভয়। ভিটেমাটি হারানোর ভয়।
এই ভয় থেকেই অভিযোগ উঠল, কৃষি আইন চাষিদের উপকারের জন্য নয়, অম্বানী-আদানিদের ফয়দার জন্য।
আর আইন প্রত্যাহারের ফলে কী হল? আগামী কয়েক দশকের জন্য চাষিরা বোধ হয় আবার সেই ঘুঘুর বাসাতেই আটকে পড়লেন। এ রকম মাপের প্রবল জনমত, সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও মোদী সরকারকে পিছিয়ে আসতে হলে, ভবিষ্যতে কি আর কোনও সরকার কৃষি সংস্কারের সাহস দেখাবে?
প্রধানমন্ত্রী নিজে অন্তত একশো বার কৃষি আইনের উপকারিতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কৃষি আইন পাশের পরে। আগে করলেন না কেন? হয়তো দরকার মনে করেননি। আন্দোলন শুরুর পরে বিজেপির নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, গ্রামে-গ্রামে ঘুরে কৃষি আইনের উপকারিতা বোঝাতে হবে। বিজেপি কর্মীরা যথাসাধ্য প্রচার করেছিলেন। এ বার প্রধানমন্ত্রী নিজেই ‘মাফ চাইছি’ বলে সরে দাঁড়ানোয় তাঁরা কোন মুখে ফের গ্রামে যাবেন? পরের বার উপরমহলের নির্দেশে সরকারি নীতির উপকারিতা বোঝাতে গিয়ে দোনামনা করবেন না তো?
মনমোহন সিংহ পরমাণু চুক্তির সময় এই পরীক্ষার মুখে পড়েছিলেন। সরকার রাখি না সংস্কার? বামেরা সমর্থন প্রত্যাহার করে পরমাণু চুক্তিতে বদ্ধপরিকর মনমোহনের গদি উল্টে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। প্রকাশ কারাট-এ বি বর্ধনদের মনমোহন বলেন, “সো বি ইট”। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি নয়। সংস্কার করতে ওই রকম প্রত্যয় প্রয়োজন হয়।