Footpath Encroachment

ফুটপাত দখল দিনে রাতে

ফাঁকা ফুটপাত মানে চলাফেরার স্বাধীনতা। যানজট, বিষাক্ত ধোঁয়া, আওয়াজ থেকে কিছুটা মুক্তি। অনেকে বাড়ি থেকে চার-পাঁচশো মিটার দূরের দোকানে টোটো বা গাড়িতে যান; হাঁটার জায়গা নেই বলে কাছের গন্তব্য মনে হয় শতযোজন দূরে।

Advertisement
অরিজিৎ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৪ ০৯:১১

কলকাতাকে অনেকে বলেন কল্লোলিনী তিলোত্তমা। কোনও শহর কল্লোলিনী তিলোত্তমা হলে কেমন দেখায় জানি না। এ প্রশ্নটা বহু দিন ধরেই মনে ঘুরছে: কুৎসিত দৃশ্য, দুর্গন্ধময় নর্দমা, একঘেয়ে সুরকে কি ভাষার মলম লাগিয়ে সুন্দর করে দেওয়া যায়? নোংরা ঘিঞ্জি ফুটপাত দিয়ে কোনও মতে হাঁটতে হাঁটতে, মানুষের গুঁতো খেতে খেতে মন কি খুশি হতে পারে? এক মাস আগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী যখন বললেন, যে সব এলাকার ফুটপাতে হকাররা জমি দখল করে বসে আছেন সেখানকার কাউন্সিলরদের গ্রেফতার করা হবে, মন উৎফুল্ল হল। এ শহরের এই দুর্বিষহ অবস্থার জন্য যাঁরা দায়ী তাঁদের শাস্তি পাওয়া উচিত। প্রথমত, দ্বিতীয়ত, শেষ পর্যন্ত ফুটপাত চাই।

Advertisement

ফাঁকা ফুটপাত মানে চলাফেরার স্বাধীনতা। যানজট, বিষাক্ত ধোঁয়া, আওয়াজ থেকে কিছুটা মুক্তি। অনেকে বাড়ি থেকে চার-পাঁচশো মিটার দূরের দোকানে টোটো বা গাড়িতে যান; হাঁটার জায়গা নেই বলে কাছের গন্তব্য মনে হয় শতযোজন দূরে। ফাঁকা ফুটপাত মানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশও, সকালে বা রাতে হনহন হাঁটলে শরীর-মন ভাল থাকত। কিন্তু কলকাতায় তা সম্ভব কই! ফাঁকা ফুটপাত মানে এক অর্থে স্বাবলম্বনেরও শিক্ষা। সন্তানকে একা বাজারহাট করা শেখাতে চান, পারবেন না, কারণ রাস্তায় বেরোলে তাকে হাঁটতে হবে রাস্তাতেই— ফুটপাতে তো বেচাকেনা চলছে। আর রাস্তায় হাঁটা মানে প্রাণ হাতে করে হাঁটা।

ফাঁকা ফুটপাত মানে গাছেদের জন্যও একটু জায়গা। শহরে গাছপালা দরকার, সে তো আর রাস্তার মাঝখানে হবে না। চাই প্রশস্ত ফুটপাত, যাতে গাছ বেড়ে ওঠার জায়গা ছেড়েও হাঁটার জায়গা থাকে। ফাঁকা ফুটপাত মানে শহরকে দেখারও সুযোগ করে দেওয়া: পুরনো অফিসবাড়ি, গির্জা, বনেদি বাড়ি, লাইব্রেরি, মধ্যবিত্তের তৈরি সুন্দর বাংলো ঢেকে আছে কদর্য ফুটপাতে।

যে কোনও শহরের ফাঁকা ফুটপাত দেখলেই বোঝা যায়, সেখানে নিয়ম মানা হয়। দোকানি-ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হন এই ভেবে, কেউ চাইলেই দোকানের সামনে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসে পড়তে পারবে না, প্রশাসন সেটা দেখবে। এ ভাবেও রাজ্যে বিনিয়োগ আনা যায়, বহু লোকের কর্মসংস্থান করা যায়, সৎ ব্যবসায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে সাহায্য করা যায়। শহরে ব্র্যান্ড লঞ্চ হবে কী করে, যদি না দোকানটাই দেখা যায়? আশ্রয় নিতে হবে একটেরে শপিং মল বা আন্তর্জালের। বিশ্বের বহু নামী ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়েছে লন্ডন প্যারিস নিউ ইয়র্কে ফুটপাতের পাশের দোকান থেকে। যে ফুটপাতে মানুষ নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারে না, সেখানে কোন বোকা কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করবে?

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কানেম্যান ও সহযোগীরা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কিছু যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্য (অঙ্গচ্ছেদ, প্রাণিহত্যা, মরণাপন্ন মানুষ) দেখিয়েছিলেন: অল্প সময় থেকে অনেক ক্ষণ। দেখা যায়, বেশির ভাগেরই মনে আছে সবচেয়ে পীড়াদায়ক দৃশ্যটি এবং শেষের দৃশ্যটি। তারা ভুলে গেছে কত ক্ষণ ধরে তারা সেই যন্ত্রণা সহ্য করেছে। একই জিনিস বার বার দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হতে আমরা ভুলে যাই, কত কাল ধরে আমরা এই নরকে আছি। অনেক কিছুর সঙ্গেই বেশ মানিয়েও নিয়েছি: ব্যবহার-অযোগ্য বাসস্ট্যান্ডের নকশা (পিছনে মনীষীদের ছবি), অটো আর গাড়িচালকদের লেন না মেনে এঁকেবেঁকে গাড়ি চালানো, কান ফাটানো হর্ন, জ়েব্রা ক্রসিংয়ের অনুপস্থিতি।

কী করণীয় তবে? প্রথমত, যারা ‘ভোট করায়’ এবং ভোটে জেতে, তাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখা, বিশেষত যা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেই। যাঁরা বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তাঁদের নিয়োগ করার ক্ষমতা তো জনপ্রতিনিধিদের আছে। দ্বিতীয়ত, ফুটপাত ফাঁকা রাখার কাজ চাঁদে মানুষ পাঠানোর মতো কঠিন নয়, অন্যত্র তা অনেক আগেই হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ইউরোপের নানা শহরের মানুষ নিজেদের দোকানপাট, ফুটপাতের কেমন যত্ন নিচ্ছেন, গুগল করেও দেখা যায়।

শহরের দশটি বড় রাস্তার ফুটপাত দু’বছর ফাঁকা রাখলেই মানুষ বুঝবে তার গুরুত্ব। প্রথম প্রথম ফাঁকা জায়গা দেখে মন হুহু করবে, নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে হাঁটতে পারলে কিছু দিনের মধ্যেই মালুম হবে, আমরাও পারি, পারব। ভুললে চলবে না ফুটপাত দখল করতে কিছু মানুষ প্রস্তুত: চারটে বাঁশ, একটা ত্রিপল, জুতসই জায়গা পেলেই হল। এক বার বসে পড়তে পারলেই ক্ষতিপূরণ। চাই প্রশাসন ও পুলিশের কড়া পদক্ষেপ।

সারা বাংলাতেই দশকের পর দশক এমন বেআইনি দখল। ফুটপাতের উপর চা-দোকানে আড্ডা দিতে কার না ভাল লাগে? মুশকিল হয় যখন ফুটপাত জুড়ে শতসহস্র চা তেলেভাজা ঘুগনি থেকে খুঁটিনাটির দোকান বসে যায়। তখন তা চলে যায় হাতের বাইরে। ভারতের প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৭০ জন বাস করেন, পশ্চিমবঙ্গে ১১০০। নানা মুলুক থেকে মানুষ রাজ্যে আসছেন রোজগারের সন্ধানে। বেকার সমস্যাও একটি কারণ। তবে প্রধান কারণ ভোট ও নোট পাওয়ার লোভ।

কথার মালা গেঁথে গেঁথে কলকাতাকে আর সুন্দর করা যাচ্ছে না। এখন কাজ করার, কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement