অন্ধবিশ্বাস মারাত্মক, ভ্রান্ত তথ্যে আস্থাও কম ক্ষতিকারক নয়
Population Census

জনশুমারির বিকল্প নেই

শতাংশ ব্যাপারটাই ভারী গোলমেলে। মনে আছে তারাপদ রায়ের সেই গল্পটি? কোনও এক মেডিক্যাল কলেজে সে বছর পুরুষ স্নাতকের সংখ্যা ছিল ১০০, আর মহিলা স্নাতকের সংখ্যা ১০।

Advertisement
অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:১১

কলকাতায় তো এখন সিক্সটি পারসেন্ট অবাঙালি,” হাতের মুঠোফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন ভদ্রলোক। জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় পেলেন এ তথ্য? আমার নিদারুণ অজ্ঞতার পরিচয় পেয়ে মুখ তুলে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। জানা গেল, বাঙালির এই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার ‘সংবাদ’টি সমাজমাধ্যমে কিছু কাল ধরেই সচল। ভদ্রলোক এক জন অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী। অবসরে গুগল ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করে লোকহিতে প্রচার করে থাকেন। বাঙালি-অবাঙালি বিষয়ে এই ‘তথ্য’টি পাওয়ামাত্রই তিনি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা শিকেয় তুলে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন লোকহিতের লক্ষ্যে। তর্ক তুলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু লীলা মজুমদারের কথা মনে পড়ে গেল। খেরোর খাতা-য় তিনি তাঁর স্বামীর প্রসঙ্গে লিখছেন, “আরে তর্ক করবি তো আমাদের মতো সোজাসুজি নিজের মতটা প্রকাশ করে যা বলবার বল! তা নয়। একরাশি তথ্য, প্রমাণ পরিসংখ্যান, শতকরা হেনাতেনা, অমুক রিপোর্টে বেরিয়েছে বলে এমনি বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড করবেন যে তর্ক করবার সব সুখ চলে যাবে।”

Advertisement

আমাদের এই বিজ্ঞানী ভদ্রলোক সেই দলে পড়েন, যাঁরা সংখ্যাবাচক তথ্যকে বিবরণমূলক তথ্যের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে থাকেন। তিনি কিন্তু বললেন না— যেমন অনেকে বলে থাকেন যে— আমাদের চার পাশে শুধু অবাঙালি! তিনি যেন সেই রাজা, যিনি ‘পুঁথির পাতে’ লেখা ‘ন্যাড়া যায় বেলতলাতে’ দেখেও সন্তুষ্ট না হয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন, ‘কিন্তু প্রশ্ন, ক’বার যায়’? এই আপাত-অনাবশ্যক তথ্য নিয়ে ভেবে অস্থির রাজাকে নিয়ে সবাই চিন্তায় আকুল— ‘রাজা বুঝি ভেবেই মোলো’। দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবাসীগণ আপাতত অবাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতার কল্পনায় ‘ভেবেই মোলো’। কলকাতার জনসংখ্যায় অবাঙালির অনুপাত ৬০ শতাংশ হলে যে ভয়ানক একটা ব্যাপার ঘটে যাবে, এমন হয়তো আমার মতো অনেকেই মনে করেন না। কিন্তু আসল উদ্বেগের বিষয় অন্যত্র। যদি কোনও ব্যক্তি তাঁর ভিত্তিহীন পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থানের সঙ্গে সত্যি-মিথ্যে কোনও সংখ্যার মিল পেয়ে যান, তাকেই তিনি প্রশ্নাতীত সত্য বলে আঁকড়ে ধরেন। মনস্তত্ত্বে একে বলে ‘কনফার্মেশন বায়াস’।

শতাংশ ব্যাপারটাই ভারী গোলমেলে। মনে আছে তারাপদ রায়ের সেই গল্পটি? কোনও এক মেডিক্যাল কলেজে সে বছর পুরুষ স্নাতকের সংখ্যা ছিল ১০০, আর মহিলা স্নাতকের সংখ্যা ১০। এঁদের মধ্যে পাঁচ জন পুরুষ ডাক্তারের বিয়ে হয় তাঁদের পাঁচ সহপাঠিনীর সঙ্গে। সেই মেডিক্যাল কলেজের এক পুনর্মিলন উৎসবের সুভেনিরে সম্পাদক রিপোর্ট করেছিলেন, “আমাদের মেডিক্যাল কলেজের শতকরা পাঁচ জন ডাক্তারবাবু শতকরা পঞ্চাশ জন ডাক্তার দিদিমণিকে আলোচ্য বছরে পরিণয়পাশে আবদ্ধ করেছেন।” বোঝাই যায় যে, আর পাঁচ জন শিক্ষিত মানুষের মতো সেই সম্পাদক মহাশয়ও শতাংশপ্রেমে অন্ধ। শিক্ষিত মানুষজন কোনও হিসাব শতাংশে থাকলে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন— আর সে জন্যই বোধ হয় একটি তরল সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় পণ্যটি ‘জীবাণুঘটিত রোগসমূহের থেকে ৯৯.৯৯% সুরক্ষা দেয়’। ১০০% না লিখে ৯৯.৯৯% লেখার পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গভীর মনস্তত্ত্ব কাজ করছে। দশমিকের পরেও দুই স্থান জুড়ে সংখ্যা দেখলে আগ্রহী দর্শকের মনে সম্ভ্রম জাগতে পারে বিজ্ঞাপকের সত্যনিষ্ঠা অনুভব করে। কিন্তু এমন অত্যাশ্চর্য পরিসংখ্যান কোন সূত্র থেকে পাওয়া গেল, সে প্রশ্ন কেউ করেছেন কি না জানা নেই।

ফিরে যাই ওই ‘সিক্সটি-ফরটি’ প্রসঙ্গে। এতগুলি মানুষ এটি বিশ্বাস করছেন জেনে একটু আতঙ্কিতই হলাম। কলকাতায় বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অনুপাত জানতে হলে একমাত্র তথ্যসূত্র হল সেনসাস বা জনশুমারি। ভারতে শেষ সেনসাস হয়েছে ২০১১ সালে। বস্তুত, কলকাতাবাসীর কত শতাংশ বাঙালি আর কত শতাংশ অবাঙালি তা জানার কোনও উপায় নেই— কারণ বাঙালির ঠিকঠাক সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। এর কাছাকাছি যে জিনিসটি জনশুমারি থেকে জানা যায় তা হল কলকাতার কত শতাংশ মানুষ জনগণনার সময়ে বলেছেন যে, তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, অন্য কিছু।

২০১১ সালের জনশুমারি থেকে পাচ্ছি যে, কলকাতার মোট জনসংখ্যার ৬১.৫% মানুষ জানিয়েছেন তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৩ বছরের মধ্যে কলকাতায় বাংলাভাষীর অনুপাত ৬১.৫% থেকে ৪০ শতাংশে নেমে আসতে গেলে তাঁদের সংখ্যা অন্তত সাড়ে সাত লক্ষ কমতে হবে, আর অবাঙালির সংখ্যা বাড়তে হবে প্রায় সাড়ে বারো লক্ষ। এই গোদা হিসাবটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাব্য হার অনুমান করে নিয়ে কষা হল। প্রশ্ন হল, বিগত ১৩ বছরে কলকাতায় কী এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেল যার ফলে কাতারে কাতারে অবাঙালি কলকাতায় ঢুকে পড়ছেন এবং বসবাস করছেন? তাঁরা নিশ্চয়ই পূর্বাবস্থায় যেমন ছিলেন তার থেকে তুলনায় আরও ভাল থাকবেন বলেই আসছেন। অথচ এই যে দিবারাত্র শুনতে পাই বিনিয়োগ আসছে না বলে কলকাতার অর্থনীতি শেষ হয়ে গেল! এমন হতচ্ছাড়া রাজ্যে অবাঙালিরা তা হলে কিসের টানে আসছেন? এই দুর্বোধ্য অঙ্ক মেলায় কার সাধ্যি!

যা-ই হোক, কলকাতায় বাংলাভাষীর সংখ্যা নিরূপণের যে সমস্যা দিয়ে শুরু করেছিলাম তা নিরসন হতে চলেছে শীঘ্রই। বিলম্বে হলেও সুখবরটি এল অবশেষে। সরকার জানিয়েছে, জনশুমারি হতে চলেছে এ বছরেই। ২০২১ সালের জনগণনা হতে চলেছে ২০২৫-এ। দেবভাষায় একেই বলে ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’। জনগণনার কাজটি যে সোজাসাপটা হবে না, তা পাঁচ বছর আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যখন ভারত সরকার জনশুমারির সঙ্গে ‘ন্যাশনাল পপুলেশান রেজিস্টার’ (এনপিআর) তৈরির কাজটিও জুড়ে দিতে চাইছিল। এনপিআর হল ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজ়েনস বা এনআরসি-র প্রথম ধাপ। এনপিআর-এর প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল ‘দেশের স্বাভাবিক অধিবাসী’-দের তালিকা প্রস্তুত করা, আর প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্যটি ছিল কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে সেই তালিকার বাইরে রাখা। অসমে এনপিআর চালু করে যে কাণ্ডটি হল, তা সকলেরই জানা। ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিক তালিকার বাইরে পড়ে গেলেন, যার মধ্যে সব সম্প্রদায়ের মানুষই রয়েছেন। এনপিআর নিয়ে প্রথম ধাক্কাটি সম্ভবত অপ্রত্যাশিত ছিল, তাই সামলাতেও সময় লাগল। ২০২১-এ যদি জনশুমারির সঙ্গে এনপিআর জুড়ে সারা দেশে তথ্য সংগ্রহ শুরু হত, ধুন্ধুমার বেঁধে যেত। ক্ষুব্ধ মানুষজন তথ্য সংগ্রাহকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতেন না। তাই হয়তো প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত করা হল। প্রকাশ্যে অবশ্য বলা হল কোভিড অতিমারির জন্যে জনশুমারি পিছিয়ে গেল।

অতীতের জনশুমারি থেকেই পরিসংখ্যান নিয়ে এবং যুক্তি দিয়ে দেখানো যায় যে, ‘অনুপ্রবেশ’ একটি অতিকথা। অতএব অনুপ্রবেশ হচ্ছে দেখাতে জনশুমারি ছেড়ে এনআরসি/এনপিআর-এর দিকেই আগ্রহ জাগিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে, অন্তত ২০২৪-এর নির্বাচন পর্যন্ত। ‘অনুপ্রবেশ’ কিংবা হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ে অনেক অতিকথা এবং ভ্রান্তি সমাজমাধ্যমে ঘুরপাক খেতে দেখি যার কোনও তথ্যভিত্তি নেই। জনগণনা যথাযথ সময়ানুসারে হলে এমন অনেক ভ্রান্তিরই নিরসন হতে পারে; অবশ্য তা হতে পারে তাঁদেরই মধ্যে, যাঁরা পরিসংখ্যানকে অন্ধবিশ্বাসের উপরে স্থান দিয়ে থাকেন। এক প্রকার ‘শিক্ষিত’ মানুষ আছেন, যাঁরা আবার তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে পরিসংখ্যানের অনেক ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে থাকেন। এঁরা কথা শুরু করেন ‘আমি দেখেছি’ বলে— “আমি দেখেছি কী ভাবে বাঙালিরা কলকাতায় সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে।” কোনও পরিসংখ্যানই এঁদের টলাতে পারে না।

ভারতীয় সেনসাস এমনই এক তথ্যভান্ডার যার বিকল্প নেই, এ কথাটি বার বার মনে করার দরকার আছে। গ্রাম থেকে শুরু করে, বা শহরের ওয়র্ড থেকে, জেলা, রাজ্য হয়ে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত তথ্যের প্রধান উৎস জনশুমারি। বিভিন্ন সামাজিক বর্গের বয়সভেদে নারী-পুরুষের সংখ্যা, তাঁদের মধ্যে সাক্ষরতার হার, কত জন কর্মরত ইত্যাদি জনশুমারি থেকেই পাই। সব মিলিয়ে প্রতিটি গ্রামের সামগ্রিক আর্থসামাজিক চরিত্রের একটি প্রাথমিক ধারণা জনশুমারি থেকে পেয়ে যাই, যা পিছিয়ে পড়া বা এগিয়ে থাকা গ্রামকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এক কথায়, দশ বছর অন্তর প্রাপ্ত এই তথ্যাবলি থেকে দেশের প্রতিটি ক্ষুদ্রতম অঞ্চলের আর্থসামাজিক প্রগতির দশকওয়ারি একটা আন্দাজ পেয়ে যাই, দেশবাসীর উন্নয়নে যার গুরুত্বের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তাই বলছিলাম, ‘শতকরা হেনাতেনা’ বাদ দিয়ে জনজীবন চলতে পারে না, তাতে তর্ক করবার সব সুখ চলে গেলেও।

আরও পড়ুন
Advertisement