তামিল সিনেমা জয় ভীম-এর পর্দায় অত্যাচারের দৃশ্যগুলো দেখে প্রশ্ন ওঠে, মানুষের প্রতি মানুষের এ-হেন নৃশংসতা কি আদৌ সম্ভব? প্রশ্নের চটক ভাঙার আগেই জানা গেল উত্তরপ্রদেশের কাসগঞ্জের সদর থানার হাজতে এক মুসলিম যুবকের মৃত্যুর ঘটনা। পুলিশের দাবি, থানার শৌচাগারে জ্যাকেটের ফিতে দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন আলতাফ!
অভিযোগ, ভিন্ধর্মের একটি মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন ওই যুবক। মেয়েটির পরিবার অপহরণের অভিযোগ করায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয় আলতাফকে। তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে! তাঁর পরিবারের অভিযোগ, টাকা দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ। তবে শোরগোল শুরু হওয়ায় পাঁচ অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তেরও নির্দেশ এসেছে। স্পষ্টতই আইনি প্রক্রিয়া থেকে বিচ্যুত হয়েছে পুলিশ। যেমনটা হয়েছিল কয়েক দিন আগে আগরার দলিত যুবক অরুণ বাল্মীকির ক্ষেত্রে। শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, গত বছর জুনে তামিলনাড়ুতে বাবা-ছেলের মৃত্যুর পিছনে পুলিশি নৃশংসতার অভিযোগেও উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো (এনসিআরবি)-র হিসাব, গত ২০ বছরে পুলিশি হাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১৮৮৮টি। গত ১০ বছরে তা হাজারেরও বেশি। সেই সব ঘটনায় পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে ৮৯৩টি মামলা। কিন্তু দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র ২৬ জন।
আইন কমিশনের পর্যবেক্ষণ, পুলিশি হাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মূলত দুর্বল ও দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রেই। ১৯৮০ সালে সাংবাদিক (পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী) অরুণ শৌরি সাতটি রাজ্যে হাজতে মৃত্যুর ৪৫টি ঘটনার তদন্ত করেছিলেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি বিষয়ে সাদৃশ্য ছিল— নিহতেরা আর্থিক ও সামাজিক ভাবে দুর্বল। অনেকের ক্ষেত্রেই সেই অর্থে কোনও অভিযোগও ছিল না, বা থাকলেও অত্যন্ত মামুলি অভিযোগ। কিছু ক্ষেত্রে অরুণ দেখেন, নিগ্রহের মাত্রা এতই বেশি যে, পুলিশি সাফাইয়ের জায়গাটুকুও কার্যত নেই। মৃত্যুর যে সব কারণ দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে আছে সাপের ছোবল, হৃদ্রোগ বা আচমকা অসুস্থতা। কারও কারও ক্ষেত্রে তো রহস্যময় মৃত্যু বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি ক্ষেত্রে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে পুলিশ। আত্মহত্যার ধরন? লুঙ্গি, বেল্ট বা পরনের কাপড়ের ফাঁস। বহুতল থেকে লাফ বা গাড়ির সামনে পড়ে দুর্ঘটনার তত্ত্বও খাড়া করা হয়েছে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
থানা লক-আপে মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে গোটা দেশেই। ২০১৯ সালে ‘ন্যাশনাল ক্যাম্পেন এগেনস্ট টর্চার’-এর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, প্রতি দিন পাঁচ জনের মৃত্যু হচ্ছে পুলিশি হেফাজতে। ২০২০ সালে ওই সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, হাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ।
পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু রুখতে ১৯৯২ সালে কলকাতা হাই কোর্ট ‘কাস্টডি মেমো’ ব্যবহারের সুপারিশ করেছিল। তাতে বলা হয় যে, নির্দিষ্ট পরোয়ানার ভিত্তিতে গ্রেফতার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় কাউকে ডাকা হলে তাঁর পরিজনকে ‘কাস্টডি মেমো’ দিতে হবে। গ্রেফতার বা হেফাজতে নেওয়ার সময়, তারিখ, স্থান, গ্রেফতার বা হেফাজতে নেওয়ার কারণ, সেই ব্যক্তির শরীরে কোনও আঘাত রয়েছে কি না— সবই লেখা থাকবে তাতে। সঙ্গে দিতে হবে তদন্তকারী অফিসারের নাম, থানার আধিকারিকের নাম, যে গাড়িতে অভিযুক্তকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার নম্বর। যে আদালতে অভিযুক্তকে তোলা হবে, তারও উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু সেই সুপারিশ মান্যতা পায়নি।
আইন বলছে, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারবিভাগীয় বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তদন্ত আবশ্যিক। তিনিই ময়না-তদন্তের জন্য দেহ পাঠাবেন। যদি তা না হয়, উপযুক্ত কারণ-সহ সব উল্লেখ করতে হবে। মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে। ময়নাতদন্তের ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ের সংস্থানও রাখা হয়েছে। সব রিপোর্ট দু’মাসের মধ্যে জমা দিতে হবে। মৃতের পরিজনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই আইনের সেই নির্দেশ শুধু খাতায়-কলমেই আবদ্ধ।
২০২০ সালে এক জনস্বার্থ মামলায় আবেদন করা হয়, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিচারবিভাগীয় তদন্ত আবশ্যিক হোক। এনসিআরবি-র এক রিপোর্ট উল্লেখ করে বলা হয় যে, ২০০৫-১৭ সালের মধ্যে পুলিশি হাজতে মৃত্যু বা বন্দি উধাওয়ের ৮২৭টি মামলার মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে বিচারবিভাগীয় তদন্ত করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, সব থানা ও তদন্তকারী সংস্থায় সিসি ক্যামেরা বসানো বাধ্যতামূলক। কার্যক্ষেত্রে তা অবশ্য হয়নি।
পুলিশের এই রোগ নিরাময়ে আইনি দাওয়াইয়ের চেয়ে প্রতিষেধকের বন্দোবস্ত করাটা কম জরুরি নয়। প্রয়োজনে পুলিশের পুনঃপ্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করার সঙ্গে সঙ্গে ‘মডেল’ থানার সংখ্যাও বাড়ানো দরকার। গ্রেফতারি ও তদন্তের ক্ষেত্রে আইন যাতে কঠোর ভাবে মেনে চলা হয়, সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আইনের রক্ষকরা যে আইনের ঊর্ধ্বে নন, সে কথা মনে করিয়ে দেওয়া চাই।